×

জাতীয়

শৈশবে করোনার থাবা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৫৯ এএম

শৈশবে করোনার থাবা

করোনা আক্রান্ত/ফাইল ছবি

মানসিক চাপ ও বাল্যবিয়ে বেড়েছে বাড়বে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা

সরকারি নারিন্দা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইন্দ্রনীল রায়। কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে স্বামীবাগের বাসিন্দা ইন্দ্রনীলের কাটত ব্যস্ত সময়। স্কুল, প্রাইভেট, তবলা ও আর্ট শেখার পাশাপাশি বিকালে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলা ছিল তার দৈনিক রুটিন। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর সব কিছু বদলে গেছে। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ইন্দ্রনীলকে থাকতে হচ্ছে ঘরবন্দিই। প্রাইভেট পড়া ও তবলা শেখার কাজটা হচ্ছে অনলাইনে। স্কুল খোলার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি পিইসি পরীক্ষা না হওয়ার সিদ্ধান্তে অনেকটাই মন খারাপ ইন্দ্রনীলের। তার ভাবনা, পরীক্ষা না হলে ক্লাস রোল কীভাবে নির্ধারণ হবে। প্রায়ই সে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় বাবা-মার কাছে। এছাড়া বাইরে বেরুতে না পারায় একঘেয়ে জীবনে অস্থির হয়ে পড়েছে সে।

দেশের নামকরা একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে বেইলী রোডের বাসিন্দা মালিহা অদিতি। মালিহার বাবা-মা দুজনই আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থায় কাজ করেন। করোনার মধ্যে তাদের সারাক্ষণ অনলাইনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। আর মালিহা ব্যস্ত থাকছে অনলাইন ক্লাসে। মালিহার মা মুনীরা ফেরদৌসী বলেন, করোনা সংক্রমণের পর থেকে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের প্রতি মালিহার আসক্তি বেড়েছে। ঘরবন্দি থাকার কারণেই হয়তো মালিহা মনমরা হয়ে থাকে। আমরা ওকে কোয়ালিটি টাইম দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু হয়তো সবটা পারছি না।

করোনা সংক্রমণ ইন্দ্রনীল কিংবা মালিহার মতো অসংখ্য শিশুর দৈনন্দিন জীবন বদলে দিয়েছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ভিশনের শিশু ও তরুণদের অংশগ্রহণে ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে ৯১ শতাংশ শিশু মানসিক চাপে রয়েছে। শিশুরা এই পরিস্থিতিতে মানসিক বেদনা ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। মহামারির সময়ে জীবনে ছন্দপতনের জন্য সরাসরি ৩টি কারণকে উল্লেখ করেছে শিশুরা। কারণগুলো হলো- শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক বেদনা এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া।

চলতি বছরের মার্চ মাসে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনিসেফের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভবিষ্যতে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু করোনার বলি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এই করোনা, যা ভবিষ্যতে শিশুদের চিকিৎসায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই আগামী ৬ মাস প্রতিদিন অন্তত অতিরিক্ত ৬ হাজার শিশু প্রাণ হারাতে পারে বলেই মনে করছে ইউনিসেফ। ৫ বছর বা তার কম বয়সের শিশুদেরই মৃত্যুর হারই বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

করোনাকালে অর্থাভাবে অষ্টম, সপ্তম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ৩ মেয়ের বাল্যবিয়ের অনুমতি চেয়ে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন মেহেরপুরের মুজিবনগরের নাজমা বেগম। মেয়েরা পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী হতে চাইলেও অভাবের তাড়নায় তাদের বিয়ে দিতে চাইছিলেন মা-বাবা। প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা আবার পড়াশোনায় ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু সবার ভাগ্য এভাবে বদলে যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় অনেক অভিভাবকই কাজ হারিয়েছেন। অভাব আর কন্যা শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত বাবা-মা ঘরের কন্যা শিশুটিকে আর নিজের কাছে রাখতে চাইছেন না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। এই সুযোগে তারা লুকিয়ে কন্যা শিশুটিকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) জরিপের তথ্য বলছে, দেশে করোনার প্রকোপে বাল্যবিয়ের হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে। জুন মাসে ৪৬২টি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বন্ধ করা গেছে ২০৭টি বাল্যবিয়ে। অথচ মে মাসেও বাল্যবিয়ে হয়েছিল ১৭০টি। বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল ২৩৩টি। সেভ দ্য চিলড্রেনের গেøাবাল গার্ল হুড প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে ২০২০ সালে কমপক্ষে আরো ৫ লাখ মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হতে পারে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে আরো অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ হতে পারে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা করছে। এ বছর আগের তুলনায় আরো ১০ লাখ বেশি কিশোরী গর্ভবতী হওয়ার ঝুঁঁকিতে রয়েছে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, করোনা মহামারির কারণে আগামী এক দশকে আরো এক কোটি ৩০ লাখ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন সহিংসতা, দুর্যোগ বা মহামারির মতো কোনো সংকট তৈরি হয় তখন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তার মনোজগতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বেড়ে যায় বাল্যবিয়েসহ শিশুর প্রতি সহিংসতা। করোনাকালেও সেই বিষয়টি দেখা যাচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক (এডভোকেসি) চন্দন জেড গোমেজ ভোরের কাগজকে বলেন, চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড ভিশনের প্রাথমিক একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রত্যেক পরিবারে আয় কমেছে। পারিবারিক খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এসেছে। আগে ৩ বেলা খাবার খেলে এখন দুই বেলায় তা নেমে এসেছে। পরিবারের নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে। অনেক পরিবার কন্যা শিশুটিকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রকোপটা যেহেতু চলমান সেক্ষেত্রে আমাদের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।

করোনাকালে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুরা বিভিন্নভাবে মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। যেমন- কুঁকড়ে থাকা, উদ্বিগ্নতা প্রকাশ, ভয় পাওয়া, রাগান্বিত বা উত্তেজিত হওয়া, ঘরকুনো হওয়া ইত্যাদি। এই কঠিন সময়ে শিশুদের বড়দের ভালোবাসা এবং মনোযোগ বেশি প্রয়োজন। তাই শিশুদের অতিরিক্ত সময় এবং মনোযোগ দিতে হবে। পরিবারে বড়দের শিশুদের পাশে থেকে কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম জানান, করোনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সবার ব্যস্ততার সুযোগে বাবা-মা কন্যাশিশুকে বিয়ে দিচ্ছেন। এটা মূলত অভাব এবং সামাজিক নিরাপত্তার কারণে। বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা তৈরি করতে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিশেষ সার্কুলার দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।

এই প্রেক্ষাপটে আজ থেকে শুরু হচ্ছে শিশু অধিকার সপ্তাহ। এ বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ৫ অক্টোবর হওয়ায় ওই দিন বিশ্ব শিশু দিবস এবং ৬ অক্টোবর জাতীয় কন্যা শিশু দিবস পালিত হবে। ‘শিশুর সাথে শিশুর তরে, বিশ^ গড়ি নতুন করে’ এ বছর শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে শিশু দিবস আর ‘আমরা সবাই সোচ্চার, বিশ্ব হবে সমতার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে জাতীয় কন্যা শিশু দিবস পালিত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App