×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ ও সামাজিক বিজ্ঞান পঠনপাঠনের গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৫২ পিএম

এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী চলছে। আমরাও করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছি। যুদ্ধটা এখন সংক্রমণ-মৃত্যুঝুঁকির চেয়েও জীবন-জীবিকা, বেঁচে থাকার লড়াই, সামাজিক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, মানুষের বহুমাত্রিক সমস্যা ইত্যাদি বিষয়েও বিস্তৃত হয়েছে। করোনার সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক লড়াই করতে হবে, এটি বিশ্বব্যাপী প্রচারিত। কিন্তু এই সময়ে আমাদের দেশে নানা ধরনের সামাজিক ব্যাধি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সেটি সচেতন মহলকে হতবাক করে তুলছে। প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসছে, প্রতারণা নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন, অমানবিক আচরণ, দালালচক্রের ক্রিয়াশীলতা, দ্রব্যমূল্যে কারসাজি, সিন্ডিকালিজম, শিশু নির্যাতন ইত্যাদি যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছে। যদিও এই সময়ে যতগুলো ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে, সেগুলোর প্রায় প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এসেছে, গ্রেপ্তার চলছে, বিচারও হচ্ছে, গণমাধ্যম সমাজের এসব ব্যাধি নিয়ে যেমন সোচ্চার থাকছে সরকারের আইন ও বিচার বিভাগও যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিদিনই সংবাদ হচ্ছে, অপরাধের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চলছে তারপরও যেন অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত করতে ভয় পাচ্ছে না। তাদের যেন ধারণা তারা হয়তো পার পেয়ে যাবে। কিন্তু অনেক ঘটনাই এখন মানুষের কিংবা গণমাধ্যমের কল্যাণে সবার নজরে চলে আসছে। সে কারণে এত অপরাধী ধরা পড়ার পরও নতুন নতুন ধর্ষক, অপরাধী, নির্যাতনকারী বা আইন ভঙ্গকারী কোনো না কোনো অপরাধ সংঘটিত করে চলছে। সিলেট এমসি কলেজের ঘটনার পর অনেকেরই ধারণা ছিল এ ধরনের ঘটনা দেশে আর কোথাও ঘটবে না। কিন্তু সিলেটেই এক স্কুলছাত্রী কলেজছাত্র কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে, আবার কক্সবাজারে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মাদ্রাসার শিক্ষক দ্বারা মসজিদের ছাদে ধর্ষিত হয়েছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেন। রাজশাহীতে একজন গির্জার ফাদারের কুকর্ম শুনে বিবেকবান মানুষ বিস্মিত হয়েছে। ঘটনা এভাবে একের পর এক ঘটেই চলছে। ভয় কেউ যেন পাচ্ছে না। সেখানেই মস্তবড় প্রশ্ন। কী করলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমবে বা অপরাধীরা এভাবে অপরাধ সংঘটন করতে সাহস পাবে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। কেউ মনে করেন কঠোর শাস্তি হলেই অপরাধ কমে যাবে। আবার কেউ কেউ মনে করেন পরিবারের অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে নতুন নতুন অপরাধীর জন্ম হবে না। এ ধরনের নানা মত ও চিন্তা রয়েছে। কোনোটিই উপেক্ষীয় নয়। তবে আমাদের মতো সমাজে জনে জনে পাহারা দেয়া কিংবা শাস্তি দেয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। সমাজের অভ্যন্তরে এখনো পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস এবং প্রচলন বেশ ক্রিয়াশীল রয়েছে। গ্রামে অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের কেউ অপরাধ করলে তার পক্ষে কেউ না কেউ তদবির ও সুপারিশ নিয়ে দাঁড়াতে দ্বিধা করে না। কোনো নারী বা শিশুকন্যা নির্যাতিতা হলে পুরুষতান্ত্রিকতা অনেকের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। ফলে অপরাধীরা পুরুষ হলে অপরাধ করতে তাদের আর কোনো ভয় ও দ্বিধা থাকে না। কারো না কারো আশ্রয়-প্রশ্রয় পুরুষরা পেয়ে থাকে। নারীদের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া খুবই কদাচিৎ ব্যাপার। যদি সেই নারী রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায় তাহলে তার পক্ষে কেউ দাঁড়াবে না। ফলে আমাদের সমাজে অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য দৃশ্যমান। নির্যাতনের শিকার নারীদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে। তবে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটনে পুরুষ অপরাধী প্রায় নিরঙ্কুশ। সেটি গ্রাম ও শহরের ক্ষেত্রে বেশি তারতম্য ঘটে না। এসব বিষয় নিয়ে আমরা গণমাধ্যমে অনেক কথাই শুনি কিন্তু কাজের কাজ বেশি কিচ্ছু হচ্ছে না। নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে বড় বড় প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে সেটিও আমরা দেখতে পাই। অনেক বড় বড় শিক্ষিত মানুষও সম্পত্তি, টাকাপয়সা, প্রভাব ইত্যাদি খাটিয়ে সমাজে নিজেদের স্বার্থ আদায় করার ক্ষেত্রে দ্বিধা করছে না। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের সমাজে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত সর্বত্রই অপরাধপ্রবণ মানুষের অবস্থান রয়েছে। কেউ কেউ অর্থবিত্তে এতবেশি শক্তিশালী হওয়ার পরও আরো বিত্ত ও অর্থের পেছনে ছুটতে দেখা যায়। সমাজের নিচের দিকে অপরাধ প্রবণতা বাড়ার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানসিক দৈন্যদশার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সে কারণেই দেশে পেশাদার দালালচক্র যেমন আছে, ঘুষ, দুর্নীতিবাজ, মানুষকে পদে পদে ঠকানোর পেশাদারিত্বও অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে এ দেশে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা, প্রতারণা, বিত্ত-ভৈববের ফন্দিফিকির করার মানুষ নেই। এক কথায় সততার অভাব সর্বত্রই দৃশ্যমান। সে কারণেই সমাজে এখন বিশ্বাসের জায়গাগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে বৃত্তের ছড়াছড়ি অন্যদিকে নৈতিকতার অধঃপতন যেন পাল্লা দিয়ে চলছে। এসবের সমাধান কোন পথে? মূলত যেসব অন্যায়, অপরাধ ও সমস্যার কথা এতক্ষণ আলোচনা করেছি এগুলোর সমাধান আপনাআপনি হবে না কিংবা জোরজবরদস্তি করেও সম্ভব নয়। তাই বলে কি সমাধানের পথ নেই। অবশ্যই আছে। সমাধান কি করতে হবে মানুষকেই। এখন এর জন্য প্রয়োজন সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মানুষ সম্পর্কে সঠিক প্রথা বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা দেয়া। সেই কাজটি খুব সহজ নয়। এটির একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মানুষের নানা বৈশিষ্ট্য, সমস্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদিকে গভীরভাবে যেসব জ্ঞানগত শাখা শত শত বছর ধরে বিশ্লেষণ করছে, মানুষকে সঠিক ধারণাও দেয়ার চেষ্টা করছে, সেসবকে শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বের সঙ্গে পঠনপাঠনে সন্নিবেশিত করা। এর জন্য সুনির্দিষ্ট পাঠক্রম ও শিক্ষাক্রম রয়েছে। আমরা মানুষের শরীরবৃত্তীয়, মনোজাগতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক পরিবর্তন ও করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কে যদি জ্ঞানগত ধারণা না রাখি কিংবা মূল্যায়ন না করি তাহলে মানুষের মধ্যে সহজাতভাবে যেসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে সেগুলোর সমাধানের উপায় থেকে আমরা অনেক পেছনে পড়ে থাকতে বাধ্য। আমাদের সমাজে ঘটেছেও তাই। আমরা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো স্তরেই শিশু-কিশোর ও তরুণদের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যেসব বিষয়বস্তু অধ্যয়ন করা প্রয়োজন সেসব খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি না। ফলে আমাদের নামে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠছে, কিন্তু মানে তাদের মধ্যে শিক্ষার গুণাবলিগুলো যথাযথভাবে প্রবেশ করছে বলে মনে হয় না। জ্ঞানের বিষয়গুলো মানুষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত, পরিবর্তিত, বিবর্তিত এবং উচ্চতর ধারায় প্রবাহিত হয় সেগুলো মানুষই বিভিন্ন জ্ঞান ও শাখায় গবেষণা ও পঠনপাঠনের মাধ্যমে ধারণ করার চেষ্টা করে থাকে। এর জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাক্রমকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উন্নত দেশগুলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু আমরা গতানুগতিক কিছু পাঠ এবং বিষয় অধ্যয়নের বাইরে খুব একটা মনোযোগী নই। সে কারণে আমাদের শিক্ষা, আমাদের মানবিক সমস্যা ও গুণাবলির করণীয় দিকগুলো সম্পর্কে মননশীল হতে খুব একটা পথ দেখায় না। সে ধরনের পঠনপাঠন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আছে বলেও মনে হয় না। আমাদের সামাজিক বিজ্ঞানগুলো মানুষের বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কীভাবে পশ্চাৎপদতাকে কাটিয়ে সম্মুখের দিকে চলমান থাকে সেই ধারণাও খুব একটা দেয় না। আমাদের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা যেসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে তা তাদের চিন্তার জগতের চেয়েও ভবিষ্যতে বিত্তশালী হওয়ার মানুষিকতা কি ধারণা ও লালন করে থাকে। আর অন্যদিকে মানবিক ও সামাজিক বিষয়গুলোতে যা পড়তে আসে তাদের মনোজগৎ ও চিন্তার জগৎকে শানিত করার তেমন শিক্ষা পঠনপাঠনে রয়েছে বলেও মনে হয় না। সে কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই চলছে নামে, মানুষ গঠন কিংবা সমাজ গঠনের জ্ঞানতাত্তি¡ক ধারণার উপস্থিতি খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমাদের সমাজে মানব চিন্তার বৈজ্ঞানিক ধারণার অনুপস্থিতি নিরঙ্কুশভাবে চলছে। আবার সমাজ সম্পর্কীয় ধারণা গতানুগতিক। ফলে এই সমাজের মানুষ হিসেবে আমরা যাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গড়ে তুলতে চাই তারা মানুষ ও সামাজিক বিজ্ঞানের প্রবহমানতা থেকে দূরে অবস্থান করছে। এর পরিণতি আমাদের জন্য মোটেও ইতিবাচক নয় বরং নেতিবাচক হয়েই ক্রমবর্ধমান ধারায় বিস্তৃত হচ্ছে। সুতরাং সামাজিক ব্যাধি হিসেবে নানা অপরাধকে চিহ্নিত করার মধ্যে আটকে থাকলে এর সমাধান হবে না। সমাধান আসবে বিশ্ববাস্তবতায় জটিল সামাজিক ও মানব মানুষের নানা অর্জন ও জীবনধারা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মাধ্যমেই। সেই কাজটি আমরা এখনো করতে পারছি না বলেই আমাদের সমাজ পাচ্ছে না আজকের যুগের মেধা, মনন, চিন্তাশীলতা, সততা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের সমাজ গঠন। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App