×

সাহিত্য

গাইবান্ধায় হারমোনিয়াম বিক্রি করে দিয়েছেন শিল্পী!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২০, ১১:১৫ এএম

গাইবান্ধায় হারমোনিয়াম বিক্রি করে দিয়েছেন শিল্পী!

শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্য পরিবেশন করছেন শিল্পীরা

বৌদ্ধ, হিন্দু, মোগল, পাঠান আমলসহ ইংরেজ শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত জেলা গাইবান্ধা। এ অঞ্চলে বিভিন্ন শাসনামলে অনেক সংগ্রাম-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। গাইবান্ধা জেলার মূল ভূখ- ছিল নদীর তলদেশে। কালক্রমে তা নদীবাহিত পলিতে ভরাট হয়। এরপর একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে নদী তলদেশের উত্থান ঘটে ও স্থল ভূমিতে পরিণত হয়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীবাহিত পলি মাটি দিয়েই গড়ে উঠেছে গাইবান্ধা।

গাইবান্ধা নামকরণ প্রসঙ্গে জনশ্রুতি আছে, প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানা এলাকায়। বিরাট রাজার গো-ধন ছিল অঢেল। তার গাভির সংখ্যা ছিল ষাট হাজার। মাঝে মধ্যে ডাকাতরা এসে বিরাট রাজার গাভি লুট করে নিয়ে যেত। এ কারণে বিরাট রাজা সুরক্ষা আর গাভির খাদ্য ও পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে নদী তীরবর্তী একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে গো-শালা স্থাপন করেন। সেখানে গাভিগুলোকে বেঁধে রাখা হতো। প্রচলিত আছে, এই গাভি বেঁধে রাখার স্থান থেকে এই অঞ্চলের কথ্য ভাষা অনুযায়ী জেলার নামকরণ হয়েছে ‘গাইবাঁধা’। কালক্রমে তা গাইবান্ধা নামে পরিচিতি পায়। জেলার ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে রাজাবিরাট প্রসাদ, নলডাঙার জমিদার বাড়ি, বামনডাঙার জমিদার বাড়ি, বর্ধনকুঠি, মীরের বাগানের ঐতিহাসিক শাহ সুলতান গাজীর মসজিদ, ভরতখালী কাষ্ঠ মন্দির, মহিমাগঞ্জ চিনিকল, বিজয় স্তম্ভ, পৌর পার্ক, ফুলছড়ি ঘাট, সাঘাটা ঘাট। বৌদ্ধ, হিন্দু, মোগল, পাঠান আমলসহ ইংরেজ শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত এই জনপদে হানা দিয়েছে করোনা।

সূত্র জানায়, গাইবান্ধায়, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ৮০। সংস্কৃতিকর্মীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় ১ হাজারের মতো। এদের মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ জনই নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত। যারা নানা অনুষ্ঠান করে সংসার চালান। আর প্রণোদনার জন্য তালিকা দেয়া হয়েছিল ৪০০ জনের। এদের মধ্য থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২ দফায় প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে মাত্র ১০০ জন সংস্কৃতিকর্মীকে। এদের মধ্যে প্রণোদনার আওতায়ই আসেননি আদিবাসি শিল্পীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ এবং ব্যক্তিগত স্থানীয়ভাবে নানা উদ্যোগ, সহায়তার পরও গাইবান্ধার

সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি একেবারেই বেহাল। কেউ চলছেন হারমোনিয়াম বিক্রি করে, কেউ চলছেন জমিজমা বিক্রি করে, কেউ চলছেন চা পাতা বিক্রি করে। কেউ কেউ জীবনের টানাপড়েনে বিভিন্ন পদস্থদের দ্বারে দ্বারে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ লজ্জায় গুমড়ে কাঁদছেন। অথচ এই দুঃসময়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। এই করোনাকালে বিপন্ন শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে সংস্কৃতি খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রণোদনা সহায়তা অব্যাহত রাখারও আহ্বান জানান তারা। নইলে শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্তরা বিলীন হয়ে যাবে।

জানতে চাইলে উদীচী জেলা সংসদের সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম ভোরের কাগজকে বলেন, সংস্কৃতির শহর গাইবান্ধা নানা আয়োজনে সারা বছরই মুখর থাকে। যেসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পেশাদার শিল্পীরা নানাভাবে আয় করতেন। করোনার থাবায় সেসব পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এমন দুরবস্থার মধ্যে সরকারের প্রণোদনা সহায়তা শুষ্ক মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো হলেও তা একেবারেই অপ্রতুল।

শিল্পী ও সংগঠক চুনী ইসলাম বলেন, সংগীত আমার নেশা এবং পেশা। আমি ২০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। করোনা আমার আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। গলা দিয়ে গান আসে না আর। করুণ পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি। আমার পরিচিতি এক শিল্পী নিরুপায় হয়ে তার হারমোনিয়াম বিক্রি করে দিয়েছে। সে বলল, হারমোনিয়াম রেখে কি হবে? এটা বিক্রি করলে অন্তত দুবেলা খাবার তো খেতে পারব! আরেক জন জমি বিক্রি করে দিয়েছে। ওদের অবস্থা দেখে আমার চোখ দিয়ে জল এসে গেছে! সরকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে তাও অপ্রতুল। জীবনের চাকা শ্লথ হয়ে আসছে।

শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক ও সংস্কৃতি সংগঠক প্রমোতোষ সাহা বলেন, গাইবান্ধার সংস্কৃতিকর্মীদের পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। বিশেষ করে যারা সংগীত শিক্ষক, তবলা শিক্ষক, যন্ত্রশিল্পী তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা পেশা বদলের চেষ্টা করলেও কোথাও কোনো চাকরিও পাচ্ছেন না। শহর এবং শহর এলাকার বাইরে অনেক বাউল শিল্পী আছেন, যারা ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে উপার্জন করে সংসার চালাত। তারা এখন হাহাকার করছে! তাদের দেখে কষ্টে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।

উদীচী গাইবান্ধার প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আফরোজা লুনা বলেন, গাইবান্ধায় করোনার পাশাপাশি হানা দিয়েছে বন্যা। অথচ এই গাইবান্ধায় বিভিন্ন দিবস ছাড়াও নানা অনুষ্ঠানে জমজমাট থাকত। এর মধ্য দিয়ে শিল্পীদের ভালোই আয় হতো। কিন্তু করোনা এসে তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। এ ক্ষতি তারা কিভাবে কাটিয়ে উঠবে? সরকারি প্রণোদনাও অপ্রতুল। এই করোনাকালে শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। নইলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App