×

অর্থনীতি

বাজারে সক্রিয় কারসাজি চক্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১২:০৫ পিএম

বাজারে সক্রিয় কারসাজি চক্র
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে অর্থনীতির চাকা আবার সচল হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় দেশের দুই পুঁজিবাজারও। মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থার একের পর এক সিদ্ধান্তে কিছুটা আশার আলো দেখতে শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এর মধ্যে থেমে নেই কারসাজি চক্র। দুর্বল কোম্পানিকে টার্গেট করে মুনাফালোভীরা সক্রিয় ছিল বাজারে। এ সময়ে বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের মুনাফা না দেয়া কোম্পানিরও শেয়ারের দর বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আলোচ্য সময়ে দুর্বল কোম্পানির দৌরাত্ম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে শুধু গতি বাড়ালেই চলবে না, গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তার রাশ টেনে ধরতে হবে। এ জন্য শুধু কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিলেই হবে না, আইনের আওতায় আনতে হবে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক জুয়াড়ি ও কারসাজি চক্রকে। নয়তো বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে না। পাশাপাশি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে ঢেলে সাজাতে হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাস ধরে পুঁজিবাজার কিছুটা গতিশীল। বাজারের সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ। দেখা গেছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর শেয়ারবাজারের লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ৪ হাজারের বৃত্তে থাকা সূচকও গত ১০ সেপ্টেম্বর ছাড়িয়েছে ৫ হাজারের কোটা। কিন্তু এর মধ্যে থেমে নেই কারসাজি চক্র। দুর্বল কোম্পানিকে টার্গেট করে মুনাফালোভীরা এখনো সক্রিয় বাজারে। এদিকে প্রায় দ্ইু ডজনেরও বেশি নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন কোম্পানিকে জরিমানাও করা হয়েছে। একই সঙ্গে কারসাজি ঠেকাতে এ পর্যন্ত শুনানিতে ডাকা হয়েছে ২২ কোম্পানিকে। জালিয়াতির ঘটনায় বিও হিসাবও বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার দরে প্রভাব বিস্তার রোধে বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে বিএসইসি। এদিকে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলো নতুন করে কোনোভাবেই মূলধন বাড়াতে পারবে না বলে বিধান দিয়েছে বিএসইসি। পাশাপাশি ন্যূনতম শেয়ারধারণে ব্যর্থ কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সব ধরনের শেয়ার কেনাবেচা ও স্থানান্তরের ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিএসইসি এখন ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে সব ধরনের আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে সব সময় ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করা বাধ্যতামূলক। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করে চলেছে ৪১ কোম্পানি। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ ছাড়াও পরিচালকদের এককভাবে স্ব স্ব কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ারধারণও বাধ্যতামূলক। এককভাবে ন্যূনতম শেয়ারধারণে ব্যর্থ হওয়ায় ২০ সেপ্টেম্বর তালিকাভুক্ত ৯ কোম্পানির ১৭ পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণা করে বিএসইসি। এবার সম্মিলিত শেয়ারধারণে ব্যর্থ কোম্পানিতে নতুন পরিচালক বসানোসহ বিএসইসির পক্ষ থেকে আইনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তাভাবনা ও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর ২০১১ সালে ন্যূনতম শেয়ারধারণ সংক্রান্ত আইনটি করা হয়। আইন করা হলেও সেটির পরিপালনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণে আইনটি করার পর তালিকাভুক্ত হওয়া অনেক কোম্পানিও ন্যূনতম শেয়ারধারণের শর্ত মানেনি। আবার অনেক পরিচালক হাতে থাকা সব শেয়ার ঘোষণা ছাড়াই বিক্রি করে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে গত মে মাসে বিএসইসির পুনর্গঠিত কমিশন ন্যূনতম শেয়ারধারণ সংক্রান্ত আইনটি পরিপালনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তারই অংশ হিসেবে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থ ৪৪ কোম্পানিকে আইন পরিপালনের জন্য ৬০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে গত ২৯ জুলাই চিঠি দেয় বিএসইসি। সেই সময় শেষ হবে আগামী ২৭ অক্টোবর। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নতুন কমিটি এ বাজারকে ভালো অবস্থানে নিতে চেষ্টা করছে। পুঁজিবাজারের যে গতি ফিরেছে, তার গন্তব্যে পৌঁছাতে সঠিক পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে বিএসইসি। তবে যাদের দিয়ে ভালো করবে সেই ডিএসই ও সিএসইতে যদি সমস্যা তাকে তাহলে সেটা সম্ভব হবে না। তাই এই দুই জায়গা থেকে দুষ্টু লোকদের সরাতে হবে। বিএসইসির বর্তমান কমিটির ওপরে আস্থা আছে, আশা করি শেয়ারবাজার সঠিক অবস্থানেই যেতে পারবে। তবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানি দুর্বল করছে উদ্যোক্তারা। এসব দুর্বল কোম্পানি নিয়ে পুঁজিবাজার সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যে হারে দুর্বল কোম্পানির দৌরাত্ম্য বাড়ছে তা পুঁজিবাজারের জন্য বিপজ্জনক। দুর্বল কোম্পানির দৌরাত্ম্য না থামাতে পারলে পুঁজিবাজারের বর্তমান ব্যবস্থা টেকসই হবে না। তাই বিএসইসিকে এখনি এসব কোম্পানিকে নজরদারির আওতায় এনে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, বিএসইসির নতুন কমিটি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে যা এ বাজারের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো কিছু সমস্যা করছে। এসব বিষয়গুলো বিএসইসি তদারকি করছে। তবে তারা আরো কিছু ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে না পারলে শেয়ারমার্কেটের এ গতি স্থায়িত্ব পাবে না। তিনি বলেন, বিএসইসি ও সরকারের উচিত, বড় কোম্পানিগুলো যেমন, হেলথ কেয়ার, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, ইনসেপটা, এসকেএফ, ইউনিলিভারের মতো বড় বড় কোম্পানিকে এ বাজারে যুক্ত করতে হবে। ডিএসই ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বাজারে ভালো-খারাপ থাকবেই। পচা কোম্পানির বিষয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতন থাকতে হবে। মৌলভিত্তি সম্পন্ন যেসব কোম্পানি ভালো ডিভিডেন্ড দেয়, সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। পচা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে আরো ঝুঁকি বেড়ে যাবে। সাধারণ অর্থে, পচা কোম্পানি বলতে ‘জেড ক্যাটাগরির’ কোম্পানিগুলোকে বোঝানো হয়। মূলত কোম্পানির পণ্য উৎপাদন বন্ধ কিংবা লোকসানে থাকায় লভ্যাংশ দিতে না পারায় ‘জেড ক্যাটাগরির’ তালিকাভ‚ক্ত করা হয়। এরকম একটি কোম্পানির নাম সিএনএ টেক্সটাইল। কোম্পানিটির পণ্য উৎপাদন বন্ধ কয়েক বছর ধরে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করার অভিযোগে সম্প্রতি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ একজন পরিচালককে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। আরেকটি কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারের কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে এক যুগ আগে। কিন্তু বর্তমানে কোম্পানিটির দর বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তবে সম্প্রতি এক নির্দেশনায় বিএসইসি জানিয়েছে, যেসব কোম্পানি বছরের পর পর সিকিউরিটিজ আইন ও বিভিন্ন বিধিবিধান লঙ্ঘন করে চলেছে, লভ্যাংশ দিলেও সেসব কোম্পানিকেও ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবনমন করা হবে। এক্ষেত্রে ‘এ’ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরিভুক্ত কিছু কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে আনা হবে। এছাড়া লভ্যাংশ দেয়া কোনো কোম্পানির ক্যাশ-ফ্লো পরপর দুই বছর ঋণাত্মক থাকা এবং পুঞ্জীভূত লোকসান পরিশোধিত মূলধনকে ছাড়িয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোর যেগুলো এখনো ‘এ’ বা ‘বি’ ক্যাটাগরির শেয়ার হিসেবে লেনদেন হচ্ছে, সেগুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে জেড ক্যাটাগরিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বিএসইসি। এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার দরের পূর্বাভাস কিংবা অপ্রকাশিত তথ্য নিয়ে গুজব ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার দরে প্রভাব বিস্তারে গুজব রটালে সিকিউরিটিজ আইনের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের নাম, প্রোফাইল ও লোগো ব্যবহার থেকে বিরত থাকতেও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন কর্মকর্তারা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অনেক ব্যক্তি বা গ্রæপ রয়েছে, যারা তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারদর নিয়ে কারসাজির উদ্দেশ্যে এত দিনে এতগুণ বাড়বে বলে মনগড়া তথ্য প্রকাশ করছে। এমনকি কোম্পানির অপ্রকাশিত তথ্যও আগাম প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে অনেক ভুয়া তথ্যও ছড়াচ্ছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হন। এসব বন্ধ করার পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে সতর্কতামূলক আদেশ জারি করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App