×

মুক্তচিন্তা

গণধর্ষণে বাংলাদেশের মানচিত্র!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২০, ০৬:৩৭ পিএম

কেন ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশের কথা কেউ ভাবতে পারছি না। মনমানসিকতার দিক দিয়ে কি তবে আমরা পাক-পরাধীনতার মাঝেই আছি? সেই সময় পাক-বর্বরতায় এ দেশের অনেক নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তাদের যোনিপথ। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে সেই পাশবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর অব্যাহত গতি বলে দেয় কিনা যে পাকিস্তানিদের পাশবিকতার বীজ অনেক পুরুষের ভেতর রয়ে গেছে, চেতনার ভেতর রয়ে গেছে।

মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম, বাবা-মা ধর্ষণের শিকার অসুস্থ কন্যাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। এই পথ বাবা-মায়ের চেনা ছিল না। হেঁটে যাচ্ছেন নিরুপায় আর অসহায়ত্বের খুঁটি ধরে। আশপাশে কেউ নেই তাদের। কিংবা আছেন। হয়তো কেউ দেখছেন দূরে দাঁড়িয়ে। কাছে আসার সাহস, শক্তির কোনোটাই যেন আর কারোর নেই। কোনোদিন কি ছিল, বোধহয় না। অপরাধীকে ধরার, বাধা দেয়ার ন্যূনতম শক্তি অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে এই সমাজ থেকে, সমাজে বসবাসকারী মানুষের হৃদয় থেকে। অনেকে এমনও বলে ফেলেন, ‘আশ্চর্য! উৎসুক মানুষ ভিডিও ধারণ করেন কিন্তু বাধা দেন না, দিতে কাছে আসেন না!’ তারা এ ক্ষেত্রে মিথ্যা বলেন না মোটেও। অথচ তারা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেন না যে, কেন অন্যরা এগিয়ে আসেন না। এগিয়ে আসতে বাধাটা কোথায় তাদের। উত্তর না খোঁজাটা এখন এক ধরনের দায়সারা, এড়িয়ে চলা বললেনওয়ালাদের। ধরি মাছ, না ছুঁই পানির মতো। এমন সমালোচনাকারীরা কখনো হিসাব কষে দেখেননি কতজন মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন। হুমকির মুখে তার গোটা পরিবার দিশাহারা হয়েছে। এমনকি অন্যের উপকার করতে গিয়ে বিনা অপরাধে উল্টো তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে, কারাভোগ করতে হয়েছে। নিশ্চিত যে, এমন দৃষ্টান্ত যোগ করলে যোগফল ছোট হবে না।

পার্বত্য এলাকার কন্যার কামিজের পেছন অংশ রক্তে ভিজে যাওয়াটা বলে দেয় কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তার যোনিপথ। এ দেশে কত পথ উন্নয়নের স্পর্শ পায়, পেয়েছে। কতশত পরিকল্পনায় নিরাপদও হয়, হয়েছেও। অথচ নারীর যোনিপথ সমাজের আবর্জনায় লণ্ডভণ্ড হয়, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, হচ্ছে। নিরাপদ হতে পারেনি আজো। কত আইন, কত শাসন অথচ তারপরও এই পথে অবাধ প্রবেশের সুযোগ রয়ে গেছে নিকৃষ্ট পুরুষের তথাকথিত এই সভ্য সমাজে। হায়রে সভ্য সমাজ। লাইন ধরে অসীম সাহসে নিকৃষ্ট পুরুষরা নারীর যোনিপথকে ক্ষতবিক্ষত করে বিকৃত উন্মাদনায় মেতে ওঠে, উঠছে। ভুলে যায় এসব নিকৃষ্ট পুরুষের দল এমনই এক যোনিপথে সে এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ভুলে যায় এমন একজন নারীর স্তন থেকে দুধ পান করে সে বেড়ে উঠেছে। যে নারী পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম সম্বোধন ‘মা’-এ ভ‚ষিত হয়ে মানবসন্তানদের আলোকিত করেছেন। গড়ে তুলেছেন পরম মায়া-মমতায় এবং নিঃস্বার্থপরতায়।

অবশ হয়ে আসা কন্যার শরীর বাবা ও মায়ের শরীরের ওপর ভর করে ফেলেছে। কতই না কন্যা সন্তানের এমন ভার তার বাবা-মা প্রতিদিন বইছেন। সন্তানের এই ভার আর কে বইবে তারা ছাড়া। আছে কে? আহা! কন্যা হয়ে জন্মানোর এ কী নির্মম শাস্তি এই সমাজে। এই ভূখণ্ডে। বিশ্বের দিকে তাকিয়ে কেউ বলে উঠতে পারেন, ধর্ষণ সব দেশেই হয়, বাংলাদেশেও হতে পারে। যদি তার ঘরের কোনো কন্যা এমন ধর্ষণের শিকার হতেন সম্ভবত তারা এমন করে অনুভব করতে পারতেন না। ধর্ষণের শিকার কন্যার বাবা-মায়ের মতোই মুষড়ে পড়তেন। পৃথিবীর সব আলো নিমিষেই নিভে যেত। পার্বত্য এলাকায় এমন নৃশংস ঘটনার রেশ না কাটতেই এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে একজন তরুণী বধূর যোনিপথকে চৌচির, ক্ষতবিক্ষত করা হলো এবং তা লাইন ধরে। সংঘবদ্ধভাবে। একের পর দুই, দুইয়ের পর তিন, তিনের পর চার, এমন করে একে একে অনেকেই। অতি বিনয়ে সমাজ এটাকে বলছে গণধর্ষণ। কেমন যেন গণজমায়েতের মতো শোনায় আজকাল গণধর্ষণ শব্দটা। এখানেও যেন একতাই বল বোধটা কাজ করে। এই শিক্ষাটা কোথায় পেল তারা, ভেবেছি কেউ।

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করোনার কারণে। ছাত্রাবাস বন্ধ থাকার কথা। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে কী করে একজন নারীকে ধর্ষণ করার সুযোগ পেল ধর্ষকরা, ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারেন না। জানা গেছে, স্বল্প বেতনভুক্ত দুজন দারোয়ানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দারোয়ানের চাকরি খেয়ে ফেলা খুব সহজ কাজ। যদি এই তথ্য সঠিক হয় তাহলে বলতে হয় যে, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের কর্তৃপক্ষ এই দুই দারোয়ানের চেয়েও কম ক্ষমতাসম্পন্ন। ধর্ষকদের এরাও সম্ভবত ভয় পান। অবাধ আর উন্মুক্ত করে রেখেছেন তারা ছাত্রাবাসকে নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য। তাই কি?

কেন ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশের কথা কেউ ভাবতে পারছি না। মনমানসিকতার দিক দিয়ে কি তবে আমরা পাক-পরাধীনতার মাঝেই আছি? সেই সময় পাক-বর্বরতায় এ দেশের অনেক নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তাদের যোনিপথ। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে সেই পাশবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর অব্যাহত গতি বলে দেয় কিনা যে পাকিস্তানিদের পাশবিকতার বীজ অনেক পুরুষের ভেতর রয়ে গেছে, চেতনার ভেতর রয়ে গেছে। আমরা যদি সান্ত্বনা খুঁজি এই ভেবে যে, সব দেশেই ধর্ষণ হয়। তাহলে এটা ভেবে সান্ত¡না খুঁজি না কেন, পাক-বর্বররা অনেক নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের কিছু বিপথগামী পুরুষ নারীর সম্ভ্রমহানি করলে সমস্যা কী।

যে পরিবারের কন্যা ধর্ষণের শিকার হন, সেই পরিবারই জানে তার কী শেষ হয়েছে। কতটা ক্ষতি হয়েছে। সাধারণত মন্ত্রী, মিনিস্টার, বিত্তবান শিল্পপতি, প্রভাবশালী, সরকারি বড় চাকুরে ও রাজনীতিবিদদের পরিবারে ধর্ষণের শিকার কন্যার ঘটনা তেমন একটা শোনা যায় না। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের কন্যারা চরম নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়ে আছে। এই শ্রেণি দুটিতে কখনো-সখনো রক্ষকও ভক্ষকে পরিণত হন। মাদ্রাসা, গির্জা, মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত কোথাও নিরাপদ নন এই দুই বিত্তের কন্যারা। উচ্চবিত্ত পরিবারে দুই-একটা ঘটনা যে নেই, তা নয়। আছে, তবে বেশ কম। চোখে পড়ার মতো নয়।

না বলে পারা যায় না যে, এই সমাজে, এই ভূখণ্ডে একজন নারী যদি তার যোনিপথকে সুরক্ষিত রাখার নিরাপত্তাটুকুন না পান, তাহলে সমাজ থেকে নিরাপদ শব্দটা মুছে ফেলা উত্তম। নিরাপত্তা বিধানের অহেতুক প্রচেষ্টা প্রহসন হয়ে নারীর অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। তখন বৈধ প্রক্রিয়ায় মানবসন্তান উৎপাদনের প্রয়োজন পড়ে না। এটা এখন সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, গণধর্ষণ একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এই সংস্কৃতির চর্চার জন্য ক্ষমতা লাগে, পেশি লাগে, আশ্রয় লাগে। এসব এখন বেশ নগদে চারপাশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এমন সময় যেন খুব কাছে যে, গর্ভবতী মায়ের গর্ভে কন্যা সন্তানের অস্তিত্বের সংবাদ আগাম জানতে পেরে বাবা-মা তাকে অংকুরেই না মেরে ফেলেন। গণধর্ষণের আর্তচিৎকার সবচেয়ে বীভৎস এ জগতে। বাবা-মা, স্বজন, পরিজন ছাড়া কেউই এই বীভৎসতার রূপ দেখতে পান না। শুনতে পান না।

পরিশেষে হতাশ ও দুঃখ নিয়ে বলতে হচ্ছে, গণধর্ষকদের বিচার করার বিচারিক ক্ষমতা জনগণকে দেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে ধর্ষণের শিকার কন্যার পরিবার আর স্বজনদের। এ কারণে বলছি, তাদের ক্ষতের মাত্রা তারাই বুঝতে পারেন যে, এর পরিপ্রেক্ষিতে কতটা ক্ষত একজন ধর্ষককে করা যায়।

গণধর্ষণ করার মনোবৃত্তি কেন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের বেশি হবে, একবার ভাবতে অনুরোধ করব শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের। বঙ্গবন্ধুর আদর্শবহির্ভূত এমন কর্মী রেখে শুধু দল নয়, গোটা দেশকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। পাক-বর্বরতার সঙ্গে তফাৎ কি থাকছে!

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App