×

সাহিত্য

আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে প্রণোদনায় পিছিয়ে যশোর!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১০:০২ এএম

আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে প্রণোদনায় পিছিয়ে যশোর!

যশোর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। ফাইল ছবি।

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ১৭তম ধারাবাহিক প্রতিবেদন।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য জেলা যশোর। এর সৃষ্টি প্রায় ২০০ বছর আগে, ১৭৮৬ সালে। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো জেলা। এই যশোরকে বলা হয়ে থাকে শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী। ১৯৮৫ সালে যশোরের চারুপীঠ সংগঠন প্রথম শুরু করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।

মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। আরবি ‘জসর’ থেকে যশোর শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেকে। এর অর্থ সাঁকো। এককালে যশোরের সর্বত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল। নদী বা খালের ওপর সাঁকো বানানো হতো। পীর খানজাহান আলি বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পেরিয়ে মুড়লীতে আসেন বলে জানা যায়। বাঁশের সাঁকো থেকে যশোর নামের উৎপত্তি। তবে অনেকের অভিমত, খানজাহান আলি আসার আগে থেকেই ‘যশোর’ নামটি ছিল।

জেলার ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে জেলা প্রশাসকের বাংলো, কালেক্টরেট ভবন, দড়াটানা, মারকাজ মসজিদ, শতাব্দীর প্রাচীন যশোর পৌরসভা, লালদীঘি পাড়, রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি, নকশীকাঁথা ও যশোর স্টিচ, বেনাপোল স্থলবন্দর। আর আছে খেজুড়ের গুড় যা পাটালি গুড় নামে পরিচিত। ‘খেজুরের রস যশোরের যশ’ বাংলার মানুষের মুখরোচক প্রবাদ। আর বাংল থেকে বিশ^ যশোরের পরিচিতি কপোতাক্ষ নদের তীরে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভ‚মির কারণে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদনের জন্ম শহরটির প্রচ্ছদও করোনার থাবায় বিবর্ণ হয়ে গেছে!

সূত্র জানায়, যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। সংস্কৃতিকর্মীর সংখ্যা রয়েছে দু’হাজারেরও অধিক। প্রণোদনার জন্য তালিকা দেয়া হয়েছিল ৬০০ জনের। এদের মধ্য থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২ দফায় প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে মাত্র ১০০ জন সংস্কৃতিকর্মীকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগ, সহায়তার পরও যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক। জীবনের টানাপড়েনে গুমড়ে কাঁদছে অনেক সংস্কৃতিকর্মী। অনেকে পেশা বদলে বিভিন্ন

মার্কেটিংয়ের কাজ করছেন। অথচ এই দুঃসময়ে সরকারিভাবে যে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে তাতেও দোনামোনা করেছেন প্রশাসনের লোকরা। তার ওপর শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য সহায়তার হাত ছিল গোটানো।

যে কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছে অনেক শিল্পীই। যা সংস্কৃতিকর্মীদের আহত এবং অসম্মানিত করেছে। এতে অনেকেই হতাশ হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, সংস্কৃতির দিকে সরকারের সুনজর না থাকলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে সবার আগে যশোর, কিন্তু প্রণোদনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে! সংস্কৃতি কর্মীদের বেঁচে থাকার রসদ বা প্রণোদনা সহায়তা বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে যশোর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান ভোরের কাগজকে বলেন, যারা সংস্কৃতিকে জীবিকা হিসেবে নিয়েছেন তাদের জীবন বদলে গেছে। বিশেষ করে যারা নৃত্য, সংগীত, তবলাশিল্পী তাদের অবস্থা করুণ। এদের মধ্যে যারা শিক্ষকতা করে জীবন চালাত তারা একেবারে বের হয়ে গেছে। তাদের স্থানীয়ভাবে, সরকারিভাবে এবং জোটের পক্ষ থেকে সবাই মিলে সহায়তা দেয়া চেষ্টা করেছি আমরা। কিন্তু তা অপ্রতুল। অথচ আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে যশোর সবার আগে, কিন্তু প্রণোদনার ক্ষেত্রে যশোর পিছিয়ে!

৩২ বছর ধরে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত এই নেতা বলেন, সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য সরকারি অনুদান একেবারেই অপ্রতুল। সংস্কৃতির দিকে সরকারের নজর বরাবরই কম। অথচ যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে তারা মনের টানেই করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কাছে আমাদের দাবি যশোরের সব সংস্কৃতিকর্মীই যেন প্রণোদনা পায়। যশোর জেলা শাখা চাঁদের হাটের সভাপতি ফারাজী আহম্মেদ সাইদ বুলবুল বলেন, যশোরের সংস্কৃতিকর্মীদের ভয়াবহ পরিস্থিতি। গান নাচ শিখিয়ে যারা সংসার চালাতো তাদের পরিস্থিতি নাজুক। এদের অনেকেই নিরুপায় হয়ে পেশা বদলে মার্কেটিং পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

ৎসরকারের পক্ষ থেকে তারা যা আশা করেছিল তাও পাননি। আমরা সরকারের কাছে শহরকেন্দ্রিক যারা সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত তাদের যে তালিকা দিয়েছিলাম তারা পাননি। বরং গ্রামগঞ্জের শিল্পীদেরই দেয়া হয়েছে। অথচ শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডই বেশি হয়। কিন্তু বাদ দেয়া হয়েছে! এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কাছে দাবি জানালে তিনি বলেছেন নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যশোর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সনোয়ার আলম খান দুলু বলেন, যারা নাচ, গান এবং অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত তাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকে বেকারত্বের বোঝা টানছেন। খর¯্রােতা নদী যেমন খালে পরিণত হয়, ঠিক তেমন হয়ে পড়েছে তাদের জীবন! অথচ যশোরের মতো একটা জেলাতে কমপক্ষে ৩ বা ৪ বার সহায়তা দেয়া উচিত ছিল। এত কিছুর পরও আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।

১৯৭৩ সাল থেকে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত গণসংগীতশিল্পী সকুমার দাস বলেন, আমরা শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং প্রত্যেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে ফান্ড তৈরি করেছি বিপদগ্রস্ত সংস্কৃতিকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে। এরপর ২৫ বিঘা জমির ধান কেটে দিয়ে কৃষককে সহায়তা করেছি, বিভিন্ন এলাকায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণ করেছি। এরপর মেয়র, এমপি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে অর্থ এবং খাদ্য সংগ্রহ করে ৪০০ কর্মীকে সহায়তা দিয়েছি। তারপরও দয়ার দান নিয়ে কদিন বাঁচবে তারা? দুর্দশা রয়েই গেছে। তাই সরকারের প্রণোদনার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের বাঁচাতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App