×

অর্থনীতি

লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ই-ওয়ালেট সেবা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৩০ এএম

লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ই-ওয়ালেট সেবা

প্রতীকী ছবি।

আর্থিকখাতে বিপদের আশঙ্কা

বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নেই, অনুমতিও নেই তারপরও ডিজিটাল ই-ওয়ালেট কার্যক্রম চালাচ্ছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এ অবৈধ লেনদেন করেছে আলোচিত ই-কমার্স কোম্পানি ‘ই-ভ্যালি’। সরাসরি এসব সেবা বন্ধের সুযোগ না থাকায় গত মার্চে ব্যাংকগুলোকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও অবাধে চলছে এসব কার্যক্রম।

কোনো প্রতিষ্ঠান ক্লোজড ই-ওয়ালেট নামে, কোনো প্রতিষ্ঠান আবার নিজের বানানো নীতিমালা তৈরি করে ই-ওয়ালেট কার্যক্রম চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলো লেনদেন করলে আর্থিক খাতে বিপদ বাড়বে। কারণ, অনুমোদনহীন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জানা গেছে, ব্যাংক একাউন্ট থেকে অনলাইনে লেনদেন করতে হলে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা থাকতে হয় অথবা ওই একাউন্টের বিপরীতে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড থাকতে হয়। কিন্তু ই-ওয়ালেটে এর দরকার হয় না। ই-ওয়ালেট হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে অ্যাপভিত্তিক অর্থ রাখার একটি ব্যবস্থা। এতে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় টাকা জমা রেখে দেশের মধ্যে অনলাইনে লেনদেন করা যায়। মোবাইল ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপে নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে এক একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে গ্রাহক নিজেই অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন। কয়েকটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানিও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ওইসব অ্যাপ দিয়ে অনলাইন কেনাকাটায় বিল পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। ওই বছরেই পেইজা নামের ই-ওয়ালেট প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পায়।

এরপর ২০১৮ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় লন্ডনভিত্তিক অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে পেইজা। এছাড়া পেইপ্যাল নামের আরো একটি ই-ওয়ালেট ব্যবস্থা দেশে কাজ করার অনুমোদন পেয়েছে। তবে পেইপ্যাল শুধু বিদেশ থেকে দেশে অর্থ আনার কাজে ব্যবহার হবে। জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’ কিছুদিন আগে নতুন সেবা ‘পাঠাও পে’ চালু করতে চেয়েছিল। তবে, এ সেবা যুক্ত করার অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও অনুমোদনের আগেই ছয় সপ্তাহ সেবাটি চালু রেখেছিল পাঠাও। এ

বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, পাঠাও আমাদের কাছে ওয়ালেট সেবা চালুর অনুমোদন চেয়েছিল, নীতিগত কারণে যার অনুমতি বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়নি। জানতে চাইলে পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হুসাইন এম ইলিয়াস বলেন, আমাদের সেবাটি ছিল ক্লোজড ওয়ালেট, যার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বাংলাদেশে নেই।

জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে ছয়টি প্রতিষ্ঠান পেমেন্ট সার্ভিস সেবাদাতা (পিএসপি) এবং পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরের (পিএসও) কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরমধ্যে আইপে সিস্টেম, ডি মানি ও ক্যাশবাবা পেয়েছে পিএসপি লাইসেন্স। আর পিএসও লাইসেন্স আছে আইটি কনসালট্যান্ট, এসএসএল কমার্স ও সূর্যমুখী লিমিটেডের। এর বাইরে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএম) দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও কেনাকাটা, বিল পরিশোধ ও লেনদেন সুবিধা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ্-বাংলার রকেট, ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইউক্যাশ, সাউথইস্ট ব্যাংকের টেলিক্যাশ, ওয়ান ব্যাংকের ওকে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাই ক্যাশ, প্রাইম ব্যাংকের প্রাইম ক্যাশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের স্পট ক্যাশ, ট্রাস্ট ব্যাংকের মোবাইল মানি, মেঘনা ব্যাংকের ট্যাপ এন পে। এ ছাড়া রূপালী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, বাংলাদেশ কমার্স ও যমুনা ব্যাংক দিচ্ছে শিওর ক্যাশ সেবা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমোদনহীন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে ই-ওয়ালেট কার্যক্রম চালাচ্ছে। যাদের কোনো লাইসেন্স নেই। লেনদেন করার অনুমতিও নেই। এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ‘ই-ভ্যালি’।

ই-ভ্যালিতে পণ্য না পেয়ে অনেক সময় ক্রেতা যখন বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিল করে দেন, তখন তার টাকা জমা হয় ই-ওয়ালেটে। পণ্যের সরবরাহ না থাকায় ই-ভ্যালি নিজেও বাতিল করে দেয় অর্ডার। তখনো গ্রাহকের টাকা ই-ওয়ালেটে জমা হয়। টাকা আর ফেরত পান না গ্রাহক, বরং অন্য পণ্য কিনে উসুল করতে হয়। উদাহরণ দিয়ে ই-ভ্যালির বঞ্চিত একজন গ্রাহক জানান, কেউ একজন আসুসের ল্যাপটপ কিনবেন বলে অর্ডার দিলেন। টাকাও জমা দিলেন। এক থেকে দুই মাস পর ই-ভ্যালি তাকে জানাল যে পণ্যটির সরবরাহ নেই। সরবরাহ আছে বেশি দরের অন্য ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ। গ্রাহক সেটাই নিতে বাধ্য হন। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটিই অবৈধ। জানতে চাইলে ই-ভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল বলেন, শুধু আমরা নই, পুরো ই-কমার্সই এখন উঠতির দিকে। ই-ভ্যালিতে বিদেশি বিনিয়োগ আনারও চেষ্টা করছি। কিছু ভুল থাকতে পারে। তবে ভালো ব্যবসা করছি, ভালো সাড়াও পাচ্ছি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ওয়ালেটের কথা বলছে, আমাদের সে ধরনের ওয়ালেট নেই। তাই লাইসেন্স নেয়ার দরকার নেই।

প্রতিষ্ঠানটির অভিনব ব্যবসায়িক কৌশল খতিয়ে দেখতে তথ্য চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার টিমগুলোও প্রতিষ্ঠানটির কাজকর্ম মনিটরিং করছে। সম্প্রতি ইভ্যালি ডটকম লিমিটেড এবং এর চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেলের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে গত সপ্তাহে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি স্বাভাবিক লেনদেন করতে পারছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ই-ভ্যালির বিপণনের ধরন নিয়ে বহু আগেই প্রশ্ন উঠেছে। ১০০-১৫০ শতাংশ অফার বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সেটা আবার নিজস্ব ওয়ালেটে জমা হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি বেআইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।

অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে সম্পর্ক ছিন্নের নির্দেশ : অনুমোদনহীন পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) ও পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরদের (পিএসও) সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোর কোনো সেবা দিতে পারবে না, এমনকি কোনো হিসাবও রাখতে পারবে না। মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত মার্চে এ নির্দেশনা জারি করেছে। সব ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস), পিএসও এবং পিএসপিকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং, পিএসপি ও পিএসও সেবা দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে ব্যাংকগুলো কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবে না। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকগুলো কোনো সংযোগ রাখতে পারবে না। আর্থিক খাতে দুর্ঘটনা এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স ছাড়াই কিছু প্রতিষ্ঠান পিএসপি ও পিএসও কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম কোনো কারণে বন্ধ হলে বা তাদের গ্রাহকরা প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ সংক্রান্ত বৈধ কার্যক্রমের ওপর গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হবে। এ ছাড়া অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কৃত্রিম অর্থ সৃষ্টি করে পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের জন্য কোনো ব্যাংক কাস্টডিয়ান হিসাব বা ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট একাউন্ট সেবা দিতে পারবে না। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব খোলা ও লেনদেন পরিচালনা করতে পারবে না। এছাড়া অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পেমেন্ট গেটওয়ে বা মার্চেন্ট এগ্রিগেশন সেবা প্রদান করা যাবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App