×

জাতীয়

বাড়ছে সামাজিক অপরাধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২১ এএম

বাড়ছে সামাজিক অপরাধ

প্রতীকী ছবি

* সমাজের দায়িত্বহীনতায় ঘটছে এমন অপরাধ * সুস্থ বিনোদনই এসব রোধ করতে পারে

দেশে হঠাৎ করেই বেড়েছে সামাজিক অপরাধ। বড় ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছে ছোট বোন, শ্বশুরের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন গৃহবধূ, সৎপুত্রের হাতে খুন হচ্ছেন বাবা ও মুমূর্ষু স্বামীকে রক্ত জোগাড় করে দেয়ার কথা বলে অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে স্ত্রীকে। করোনা সংকটকালীন সময়েও প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এমন ধরনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ ও সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় সমালোচনা ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। যদিও এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করলেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ছাড়াও সমাজের প্রতিটি অংশ আসলে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। এসব ঘটনা বাড়ার পেছনে করোনার কিছুটা হাত রয়েছে বললেও ভুল হবে না। কারণ মানুষ অনেকদিন ধরে গণ্ডিবদ্ধ জায়গায় এক প্রকার কর্মহীন হয়ে আবদ্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের মধ্যেই এ ধরনের প্রবৃত্তি তৈরি হতে পারে। তবে এসব অপরাধ রোধে আইনি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বেশি কার্যকর হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ধর্ষণ হয়েছে ৮৮৯টি, স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৮৯ নারী, শিশু খুন হয়েছে ৪০৮টি যাদের অধিকাংশের বয়স ৬ এর নিচে।

র‌্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি সামাজিক অপরাধ ভয়াবহ আকারে বেড়ে গেছে। আমাদের মধ্যে আসলে সহিষ্ণুতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-মমত্ববোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উত্তরার ঘটনা যদি আমরা দেখি ভাই ছোট বোনকে হত্যা করেছে। আসলে পারিবারিক বন্ধনে ফাটল ধরার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। আরেকটি বিষয় হলো বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যম এবং টেলিভিশনে কিছু কনটেন্ট দেখে অনেক ক্ষেত্রেই অসহিষ্ণু ও অ্যাডভেঞ্চারার্স হয়ে পড়ছে মানুষ। এসব বিষয়ে সবার আরো যত্নবান হওয়ার বিকল্প নেই। এক প্রশ্নের উত্তরে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, মূলত যে ধরনের অপরাধ ঘটছে তার একটি হলো প্রতিরোধমূলক, আরেকটি প্রতিকারমূলক। এ দুক্ষেত্রেই র‌্যাব ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতেও রাখবে।

গত ২৩ সেপ্টম্বর বুধবার সকালে ১৪ বছর বয়সি বড় ভাই আল আমিন চার বছর বয়সি ছোট বোন নুসরাত জাহান মিমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে র‌্যাবের তদন্তে উঠে আসে ছোট বোনের প্রতি মা-বাবার বেশি ভালোবাসায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে খুন করে আল আমিন। গত ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার রাজধানী মিরপুর পল্লবীর একটি বাসায় ৬৫ বছর বয়সি শ্বশুরের হাতে ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। তিনি জরুরিসেবা ৯৯৯ ফোন করে সহায়তা চান ধর্ষিতা।

পরে আটক হলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন শ্বশুর। গত ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাত ২টায় মিরপুর থানাধীন মধ্য মনিপুরপাড়া এলাকায় মুমূর্ষু স্বামীকে রক্ত জোগাড় করে দেয়ার কথা বলে অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এক ব্যক্তি। এ কাজে অভিযুক্তকে সহযোগিতা করেন অপর এক নারী। পরে তাদের দুজনকে আটক করে পুলিশ। দক্ষিণখান থানার ফায়দাবাদ এলাকায় স্ত্রীর আগের ঘরের ১৫ বছর বয়সি ছেলের হাতে খুন হন বাবা মো. মিলন শেখ। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেয়ায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানায় পুলিশ। গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সাভারে স্কুলছাত্রী নীলাকে ছুরি মেরে হত্যা করে বখাটে মিজান। সর্বশেষ ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসেন দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার এক দম্পতি। এ সময় স্বামীসহ ওই গৃহবধূকে পার্শ্ববর্তী ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, অপরাধ বিজ্ঞানে আইনি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সমাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বেশি কার্যকর। তবে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণটিই হচ্ছে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা। সমাজের প্রত্যেকটি অংশ পরিবার, প্রতিবেশী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নিয়ন্ত্রণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই চলছি। পুঁজিবাদী সমাজে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার বিষয়টা একরকম উপেক্ষিত। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি এমন ঘটনা বেড়ে যওয়ার পেছনে করোনার হাতও থাকতে পারে। কারণ মানুষ অনেকদিন ধরে গণ্ডিবদ্ধ জায়গায় এক প্রকার কর্মহীন হয়ে আবদ্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের মধ্যেই এ ধরনের প্রবৃত্তি তৈরি হতে পারে। আমরা দেখেছি শ্বশুর তার প্রতিবন্ধী ছেলের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন। সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য এ নারী জরুরি সেবার সহায়তা নেন।

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, আসলে তিন কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। প্রথমত, সেক্সুয়াল ড্রাইভ থেকে, দ্বিতীয়ত, শত্রুভাবাপন্নতা। আর তৃতীয়ত, মেয়েদের প্রতি কর্তৃত্বপরায়ণতা, ঘৃণা ও ইগনোরেন্স থেকে। তৃতীয় ধাপটি বিপজ্জনক বেশি। কারণ এরকম ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। তবে এসবের হাত থেকে মুক্তি পেতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সুস্থ বিনোদনের পাশাপাশি নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষ নিজ কাজে অধিক মনোযোগী হবেন। এছাড়া শুধু চাঞ্চল্যকর বিষয় নয়; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সব বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App