×

সাময়িকী

বাঙালির ঐতিহ্যচর্চার নিরলস সাধক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৪৯ পিএম

বাঙালির ঐতিহ্যচর্চার নিরলস সাধক

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক ধ্যান-নিমগ্ন যোগী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী না হলেও তিনি নিজ সাধনাবলে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃত বা উপেক্ষিত এমন রত্নরাজি উদ্ধার করেন এবং জনসমক্ষে প্রচার করেন যে তিনি উপরোক্ত সম্মান অর্জনের উপযুক্ত বিবেচিত হন। বিশ শতকের প্রথমদিকে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলমান সাহিত্যিক, যার প্রবন্ধ কলিকাতার প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ জীবিতকালেই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ-চর্চার প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রাচীন বাংলা পুথি সংগ্রহ করেন, পুথির পাঠোদ্ধার করেন, পুথির পরিচিতি নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেন, প্রাচীন পুথি সম্পাদনা করেন এবং পুস্তক রচনা করেন ও প্রকাশ করেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে এই-ই তার কাজ। উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য আবিষ্কার করে এমন এক স্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন যা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই জন্যই তিনি অর্জন করেছেন সাহিত্যবিশারদ এবং সাহিত্য সাগর উপাধি।

তার জন্ম ১১ অক্টোবর ১৮৭১ সালে পটিয়া থানার সুচক্রদণ্ড গ্রামে। ১৮৯৩ সালে তিনি পটিয়া স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন, মুসলীম ছাত্র হলেও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তাঁর অন্যতম বিষয় ছিল সংস্কৃত। সংস্কৃত জ্ঞান-পরবর্তী জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ হয় তাঁর সাহিত্যচর্চায়। ড. শহীদুল্লাহর মতে, সম্ভবত গোটা বাংলাদেশে আধুনিক যুগে তিনিই প্রথম সংস্কৃতপড়ুয়া মুসলমান। ২২ বছর বয়সে আবদুল করিম ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। বাড়ির দেউড়ীতে কিছুদিন পড়ে তিনি গ্রামের মধ্য বাংলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে এক বছর পড়ে ভর্তি হন পটিয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে। যাই হোক এন্ট্রান্স পাস করে তিনি সমকালীন মুসলিম সমাজের জন্য সুনাম অর্জন করেন। তখন মুসলমান সমাজে এন্ট্রান্স পাসের এমনই গুরুত্ব ছিল। অর্থাৎ সেকালে মুসলমানরা সবেমাত্র ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে এফএ ক্লাসে দুই বছর অধ্যয়ন করেন, পরীক্ষার কিছু সময় আগে তিনি টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হলে পরীক্ষা দেয়া আর হয়নি এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার এখানেই সমাপ্তি ঘটে।

এই সময় থেকে আবদুল করিমের পরিবারের আর্থিক অবস্থারও অবনতি ঘটতে থাকে। তার কারণ একদিকে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড়। এতে আবদুল করিমের পরিবারও ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে সামান্য জমিজমা যা ছিল তাও ঋণের দায়ে এবং মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে পরিবার এমন এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় যে উপার্জনক্ষম সদস্যদের চাকরির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। আবদুল করিমের প্রথম চাকরি চট্টগ্রাম পৌর বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। এই স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি এক বছরের চুক্তিতে সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন (১৮৯৫-৯৬ইং)। সীতাকুণ্ড স্কুলে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম সাব-জজ আদালতের অস্থায়ী কেরানির শিক্ষানবিস পদে কাজ পান। সেখান থেকে তিনি ১৮৯৭ সালে পটিয়ায় দ্বিতীয় মুন্সেফ আদালতে বদলি হয়ে যান।

এফএ পড়ার সময় আবদুল করিমের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় এবং সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তিনি কবি নবীন সেনের সঙ্গে পরিচিত হন। নবীন চন্দ্র সেনও ছিলেন চট্টগ্রামের ছেলে। আবদুল করিম এফএ পড়ার সময় অক্ষয় চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’ নামে এক দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। নবীন চন্দ্র সেন তখন কলিকাতার আলীপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি পূর্ণিমা পত্রিকায় আবদুল করিমের প্রবন্ধ পাঠ করে এই নবীন লেখকের প্রতি অনুরাগী হন। নিজের জন্মভ‚মি চট্টগ্রামের একজন মুসলমান ছেলের এই সাহিত্যচর্চা তাকে মুগ্ধ করে। নবীন সেনের মতো একজন যশস্বী কবি ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশংসা পেয়ে এফএ পড়ুয়া ছাত্র আবদুল করিমও বেশ উৎসাহ বোধ করেন। আবদুল করিমের এই গুণমুগ্ধ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচিবরূপে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এসেই তিনি আবদুল করিমের খোঁজ করেন এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে অ্যাপ্রেনটিস কেরানি রূপে কমিশনারের অফিসে বদলি করে আনেন। এই অফিসে এসে আবদুল করিম কিছু কুচক্রী লোকের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ওই অফিসের একদল কর্মচারী আবদুল করিমের প্রতি কবি নবীন সেনের প্রীতি সুনজরে দেখেনি। বছরখানেক চাকরি করার পরে এমন একটি ঘটনা ঘটে যাকে বিরোধীপক্ষ কাজে লাগায়।

কালীশংকর চক্রবর্তী নামক আবদুল করিমের স্বগ্রামবাসী একজন লোক ‘জ্যোতি’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ওই পত্রিকার এক সংখ্যায় কমিশনার অফিসের একটি গোপন সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঐ পত্রিকাতেই আবার আবদুল করিম নি¤œরূপ একটি বিজ্ঞাপন দেন- “প্রাচীন গীত পুথি বারমাস্যা প্রভৃতি যিনি সংগ্রহ করিয়া দিবেন তাঁহাকে আমরা এক বৎসরকাল ‘জ্যোতি’ বিনামূল্যে দান করিব।’ বিজ্ঞাপনটি আবদুল করিমের নামে প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপন থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা কমিশনার মি. জি আই ম্যানেস্টির কাছে অভিযোগ করে যে আবদুল করিমের দ্বারাই অফিসের গোপন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আবদুল করিম নবীন সেনের লোক, তাকে নবীন সেন চাকরি দেন, অতএব জ্যোতি পত্রিকার সঙ্গে নবীন সেন এবং আবদুল করিম উভয়ের সংযোগ আছে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে নবীন সেন বা আবদুল করিম কারো পক্ষেই সংবাদপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব ছিল না। এটা সরকারি চাকরিবিধিতে গুরুতর অপরাধরূপে গণ্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাদের কারও যোগাযোগ ছিলও না। নবীন সেন জানতেন না যে আবদুল করিম সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, আর আবদুল করিম বুঝতে পারেননি যে নিছক সাহিত্য সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনে এইরূপ ঘটনা ঘটবে। কমিশনার উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন, ১৮৯৮ সালের আগস্ট মাসে নবীন চন্দ্র সেন ময়মনসিংহে বদলি হন এবং আবদুল করিম চাকরিচ্যুত হন। আবদুল করিমকে সরকারি চাকরির জন্য অবাঞ্ছিত ব্যক্তি বলেও ঘোষণা করা হয়, পরে অবশ্য এই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এই ঘটনার কথা কবি নবীন চন্দ্র সেন তার ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

চাকরিচ্যুত হলে কবি নবীন চন্দ্র সেন আবদুল করিমকে রেঙ্গুনে গিয়ে চাকরি করার পরামর্শ দেন। সেই সময়ের একজন এন্ট্রান্স পাস ছেলে রেঙ্গুনে গেলেও ভালো চাকরি করতে পারতেন, কিন্তু আবদুল করিম জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যেতে উৎসাহ পাননি। আজহার উদ্দিন খান এই বিষয়ে লিখেন- নিজের জন্মভ‚মি ছেড়ে বাইরে কোথাও তিনি থাকতে পারতেন না, চট্টগ্রামের বাইরে যেতেও চাইতেন না। পরবর্তীকালে যখন তার খ্যাতি হয়েছে তখনও অনেকেই হয় ঢাকা কিংবা কলিকাতার কাছাকাছি থাকতে বলেছেন। ঢাকার ধানমন্ডিতে এক ব্যক্তি বাড়ি করার জন্য জমি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নেননি। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে চাকরিচ্যুতির সময়ে তিনি পুথি সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান এবং তখন তিনি বুঝতে পারেন এক অজানা জ্ঞানের সাগর তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রেঙ্গুনে গেলে তার জীবনের ঐ বিরাট সম্ভাবনা ভেস্তে যাবে। তাই দেখা যায় তিনি অন্য কোনো চাকরি না নিয়ে স্কুলের শিক্ষকতা জীবনই বেছে নেন।

রাজচন্দ্র সেন নামক এক ব্যক্তি তখন চট্টগ্রাম কালেক্টরেটে নাজির পদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন আঠার শতকের কবি এবং ‘সারদাসঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা মুক্তারাম সেনের বংশধর। পৈতৃক বাড়ি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী আনোয়ারা থানার আনোয়ারা গ্রামে। এখানে প্রচুর জমিজমা নিয়ে তার রয়েছে জমিদারি। তিনি ১৮৯০ সালে ‘আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুল’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন কলকাতা রামকৃষ্ণ মঠের স্বামী ‘পবিত্রানন্দ মহারাজ’। তৎকালীন অনগ্রসর কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীদের সজীব ও শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যই ছিল রাজচন্দ্র সেনের প্রচেষ্টা। আজকের আনোয়ারায় তখন কোনো স্কুল ছিল না। গৃহস্থের বাড়ির আঙিনায় গুরু মহাশয়রা নিজেদের পাঠশালা চালাতো। অবস্থাপন্ন লোকেরা ছেলেদের চট্টগ্রাম শহর বা পটিয়ায় পাঠিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে ইংরেজি স্কুলে পড়াতেন। চাষা, গরিব কিংবা মধ্যবিত্তের ছেলেদের গ্রামে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সুদূর অতীত থেকে এখানে একটি মুন্সেফি আদালত ছিল, তাও পটিয়ায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। ওই গৃহে একটি রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম চালু ছিল। কাছেই আনোয়ারা পুলিশ ফাঁড়ি। ১৮৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার আনোয়ারা পুলিশ ফাঁড়িকে ‘আনোয়ারা থানা’য় উন্নীত করেন। রাজচন্দ্র সেন ওই বছরই রেজিস্ট্রি অফিসের পুকুর পাড়ে ছনের ছাউনির মাটির ঘর তৈরি করে ‘আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুল’র কার্যক্রম শুরু করেন।

১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক স্কুল থেকে বিদায় নিলে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ খালি হয়ে যায়। রাজচন্দ্র সেন একজন বিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক খোঁজ করছিলেন। একই অফিসে চাকরির সুবাদে আবদুল করিমের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারই স্কুলে শিক্ষকতার জন্য আবদুল করিমকে আহ্বান জানান। এ দুঃসময়ে রাজচন্দ্র সেনের আহ্বান উপেক্ষা করাও যায় না। আবার মনে দ্বিধাও জাগলো, দ্বিধার কারণ হলো- প্রধান শিক্ষকের পদ না পেলে তিনি যোগদান করবেন না। তখনকার মৌলিক-প্রথানুযায়ী হিন্দু প্রতিষ্ঠিত কোনো স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্তি পেতেন না কোনো মুসলিম শিক্ষক। তাছাড়া আনোয়ারা হিন্দুপ্রধান এলাকা। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রাজচন্দ্র সেন স্থানীয় গণ্যমান্যদের সাথে আলোচনা, তর্কবিতর্ক করে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন আবদুল করিমকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। দ্বিধা-দ্ব›দ্ব সরিয়ে আবদুল করিম আনোয়ারা গ্রামে গেলেন। রাজচন্দ্র সেন প্রধান শিক্ষকের নিযুক্তি পত্রই সরাসরি তুলে দিলেন আবদুল করিমের হাতে। ১৮৯৯ সালের শুরুর দিকে আবদুল করিম আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। আবদুল করিম এবং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রাজচন্দ্র সেন, উভয়ের প্রচেষ্টায় গরিব কৃষি পরিবারের ছেলেরাও লেখাপড়ায় আগ্রহী হয়ে ওঠে, যাদের সামর্থ্য ছিল না তাদের বিনাবেতনে পড়ার ব্যবস্থা নিলেন, এমনকি হেডমাস্টার আবদুল করিম তার সামান্য বেতন থেকেও গরিব ছেলের বইখাতা দিতেন এবং মাসিক সাহায্যও করতেন। তার ছাত্রদের মধ্যে সারদাচরণ চৌধুরী, শশী নন্দী, সুরেন্দ্র খাস্তগীর, সতীশচন্দ্র সেন, যোগেশচন্দ্র সেন, নিশিচন্দ্র ঘোষ উকিল আবদুল জলিল চেীধুরী, উকিল মনির আহামদ মিয়া, উকিল বীরেন্দ্র কুমার দাশ, উকিল মখলেছুর রহমান ইত্যাদি পরবর্তী জীবনে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তারা সকলেই শিক্ষক আবদুল করিমের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং অনেকের পড়ালেখার সমস্ত খরচও বহন করেছেন তিনি।

আবদুল করিম আনোয়ারা স্কুলে ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতাই তার পুথি সংগ্রহের বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। স্কুলের হেডমাস্টার এলাকার একজন গণ্যমান্য, সুপরিচিত ও সম্মানিত লোক, চারদিকে অসংখ্য ছাত্র, তাছাড়া তিনি যে শুধু প্রধান শিক্ষক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক ও সাহিত্যিক। তার প্রথম সম্পাদিত কাব্য ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ ঐ স্কুলে থাকতেই প্রকাশিত হয়। আনোয়ারা স্কুলে শিক্ষকতাকালে তিনি কিছুদিন পাশের গ্রাম শিলাইগড়ার থনাদার বাড়িতে থাকতেন, এরপর তিনি নিকটস্থ শোলকাটা গ্রামের তারই ছাত্র আজিজুর রহমান কেরানির বাড়িতে চলে যান এবং স্কুল থেকে বিদায় নেয়া পর্যন্ত সে বাড়িতেই ছিলেন। তিনি ছাত্রদের পুত্রবৎ জ্ঞান করতেন ফলে আশপাশের সকলের সঙ্গে পরিচয় এবং যোগাযোগ স্থাপিত হয়। যেখানেই তিনি থাকতেন সেই বাড়িতেই পুথি পাঠের আসর বসাতেন এবং উপস্থিত সকলের কাছ থেকে প্রাচীন পুথির খবরাখবর নিতেন এবং সংগ্রহ করতেন। তিনি নিজে বলেন ‘ঘটনাস্রোতের আবর্তনে আমার জীবনে একটা পরিবর্তন আসিয়া পড়ে। আমি আনোয়ারায় গিয়া পড়ি। সেখানেই আমার জীবনের ঐধষপুড়হ ফধুং অতিবাহিত হয়। সুযোগ পাইয়া চতুর্দিক হইতে প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করিতে করিতে বুঝিতে পারি যে হিন্দুর মত মুসলমানেরও একটা বিরাট সুগঠিত ও উন্নত প্রাচীন সাহিত্য আছে।’

পুথি আবিষ্কার আবদুল করিমের জীবনে এক নতুন প্রেরণা জোগায় এবং বলা যায় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পুথির পাঠ উদ্ধার করে তিনি বুঝতে পারেন, এই পুথি প্রমাণ করে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান কোনো অংশে খাটো নয়। এতে তিনি অত্যন্ত প্রীত হন এবং সন্তোষ লাভ করেন। তার মনে বিশ্বাস জন্মাল যে এই পাণ্ডুলিপি মুসলমানদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। ড. এনামুল হক বলেন, ‘পদ্মাবতীর প্রাচীন পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার আবদুল করিমের জীবনের প্রথম ও স্মরণীয় ঘটনা। এটি জাতির পক্ষেও এক মূল্যবান আবিষ্কার। এই আবিষ্কারকে ভিত্তি করে আজ জাতির প্রাচীন সাহিত্য সাধনার সৌধ গড়ে উঠেছে।’ দ্বিতীয়ত পদ্মাবতী আবিষ্কারের পরে আবদুল করিমের মনে গবেষণার নেশা তীব্র হয়ে দেখা দেয়। এর পর থেকে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে তার প্রচেষ্টা আরও দুর্বার আকার ধারণ করে। তিনি খোঁজ পান শিলাইগড়া গ্রামের মহুরি বাড়ির বুধা গাজী এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পুথি প্রেমিক, প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে পুথির আসর বসান। তার কাছে অনেক প্রাচীন পুথি সংগ্রহে আছে। ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পরলোক গমন করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App