×

মুক্তচিন্তা

পেঁয়াজ নিয়ে হৈ-হুল্লোড় কবে শেষ হবে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:১৪ পিএম

প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি এখনো। কিছু পেঁয়াজ প্রতি বছরই আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৬ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশে প্রায় ১৭-১৮ লাখ টন উৎপাদন করা যায় এবং বাকিটা আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজ আমদানির ৮০ ভাগই আসে ভারত থেকে। অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে চীন, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশ। পাবনা, ফরিদপুর এবং রাজবাড়ী মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের ৫০ ভাগ উৎপাদন করতে সক্ষম। বাংলাদেশে সাধারণত পেঁয়াজ উৎপাদন হয় বছরে একবার। কিছু বিশেষ জাতীয় পেঁয়াজ সারাবছর ধরে উৎপাদিত হলেও এর পরিমাণ কম। নতুন পেঁয়াজের ফসল ঘরে ওঠে শীতের শেষে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে। আর তা সংরক্ষণ করা হয় সারা বছর চলার জন্য। সাধারণত আগস্টের পর থেকে উৎপাদিত পেঁয়াজের মজুত কমে যাওয়ায় বছরের বাকি সময়টা আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ সময়ের মধ্যে প্রধান আমদানির উৎস ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদনে কিংবা সরবরাহে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব ফেলে। এটি প্রতি বছরের হিসাব এবং কম-বেশি সবারই জানা বিষয়। আবহাওয়াজনিত কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যাহত হলে কিংবা রাজনৈতিক কারণে ভারত সরকার কখনো কখনো পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। কখনো আবার মূল্যবৃদ্ধি করে। ভারতে পেঁয়াজের দাম রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। ভারত সরকার পেঁয়াজ নিয়ে সর্বদাই একটু বেশি সতর্ক থাকে। ভারত সবার আগে তাদের ভোক্তাদের কথা এবং তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাববে তা খুবই স্বাভাবিক। গত ছয় মাসে ভারতে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। সামনেই তাদের বিহারের বিধানসভা নির্বাচন এবং মধ্যপ্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচন। তার আগে পেঁয়াজের অগ্নিমূল্যের খেসারত দিতে চায় না মোদির বিজেপি সরকার। তাই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তারা পেঁয়াজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে হঠাৎ করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হঠাৎ করে পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব অনুতপ্ত। বিশ্ব রাজনৈতিক কারণে এবং প্রতিবেশীর অনুভ‚তিতে সমর্থন জানাতে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুতপ্ত হলেও বাণিজ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ কারণে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার জন্য নিশ্চয়ই অনুতপ্ত নয়। কেননা তারা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখবে সবার আগে। সেখানে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা নেপালে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় তাদের অভ্যন্তরীণ পেঁয়াজবাজারে কতখানি আগুন লাগল তা দেখার দায়-দায়িত্ব তাদের কি সত্যি সত্যিই আছে? বাংলাদেশে পেঁয়াজের প্রতিদিনের চাহিদা ৬ হাজার ৯৪৪ টন। ইতোমধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, দেশে প্রায় ৬ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত আছে। সেই হিসাবে আরো তিন মাস চলার জন্য মজুত আছে বাংলাদেশের পেঁয়াজ। তবে এরই মধ্যে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণায় দাম হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশে। এমন অস্থিরতা দুটি কারণে হয়। ভোক্তারা ভয় পেয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেঁয়াজ কিনতে চায় এবং অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দেয়। বাজার অর্থনীতিতে মুনাফাসর্বস্ব নীতির লক্ষ্যে ধাবিত বাবসায়ীরা এমনটা করবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ভোক্তারা ভয় পেয়ে যাবে, তাও বাজার অর্থনীতিতে অবাক করার বিষয় নয়। এমন অবস্থায় পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি এখানে কোনো ভৌতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করিনি। এমনকি সিন্ডিকেট বলে যাদের দোষারোপ করা হয়, তাও আমার কাছে নিতান্ত মুখরোচক সেøাগান বলেই মনে হয়েছে। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ এবং বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানির বিষয়টি যারা যোগসূত্র করার চেষ্টা করেন, তাদের পক্ষেও আমি যেতে পারিনি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১৯৭.৯ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি করেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ১ হাজার ৪৭৫ টন ইলিশের চালান ইতোমধ্যে ভারতে পাঠানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শর্তানুযায়ী অক্টোবরে মধ্যে বাকি ইলিশ রপ্তানি করা হবে। ইলিশ রপ্তানির বিষয়টি নিশ্চয়ই ভিন্ন বিষয় এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক উদারতার চিহ্ন বহন করে। তবে হঠাৎ করে পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধ করার বিষয়টি বাংলাদেশে আগেভাগে জানালে তাতে ভারতের কী ক্ষতি ছিল তা ঠিক বুঝতে পারিনি। বন্ধু প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের কাছে এটুকু তো চাইতেই পারে বাংলাদেশ। তার ওপর গত বছরের পেঁয়াজ বিষয়টি আমাদের প্রধানমন্ত্রী অফিসিয়ালি তাদের নজরে এনেছিলেন। যা হোক ভারতের কথা বেশি বলতে চাই না। তাদের ওপর আমদের একটু বেশি ভরসা থাকতেই পারে। কিন্তু দিন শেষে তারা তাদের বাণিজ্য লক্ষ্মীতেই মন দেবে এমনটাই আমরা বুঝি। অন্যদিকে তারা তাদের রাজনীতি বুঝে চলবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। আমরা বরং আমাদের কথাই বলি। পেঁয়াজ সমস্যা কি আমরা সমাধান করতে পারি না? সেপ্টেম্বর এলেই যে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি হতে পারে, তা আমাদের ব্যবসায়ীরা ঠিকই বুঝে এবং সেই অনুযায়ী মজুত করে রাখে বাজারে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। ভোক্তারাও জানে, এ সময় হু হু করে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পায়। এরা সবাই জানলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কি তা জানতে পারে না? তাদের খাতায় কি এই সোজা হিসাবটি নেই? সময়মতো তারা যদি মনে রাখতে পারত, তবে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধটি আমাদের বাজারে আগুন ছড়াতে পারত না। বিশেষ করে ২০১৯-এর অভিজ্ঞতা যদি আমাদের ন্যূনতম শিক্ষা দিত, তবে ২০২০ সালে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারত না। আমার কাছে বিষয়টি খুব কঠিন বলে মনে হচ্ছে না। তবে সঠিক সময়ে সচেতনতার অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করলেই আগামী বছর পেঁয়াজ সমস্যার জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না বাংলাদেশের। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির উদ্যোগ নিতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে পর্যন্ত পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি না পায়। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতি একর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় মাত্র ৪ টন, ভারতে ৬ টন এবং চীনে প্রায় ৯ টন। চীনের কথা ছেড়ে দিলেও যদি ভারতের সমপর্যায়ের উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের হয় অর্থাৎ প্রতি একরে যদি বাংলাদেশ ৬ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করতে সক্ষম হতে পারে, তবে হয়তো বাংলাদেশের আর পেঁয়াজ আমদানি করার প্রয়োজনই হবে না। উচ্চফলনশীল বীজ, আধুনিক চাষ আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। অন্যদিকে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে চিন্তা করা যেতে পারে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত এবং সংরক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করে সারাবছর সব অঞ্চলে পেঁয়াজ পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। আমদানিতে শুধু ভারতকে প্রাধান্য না দিয়ে ভারতের সঙ্গে চীন, মিসর এবং তুরস্ককে সমানভাবে গুরুত্ব দিলে ভারতের ওপর আমদানি নির্ভরতা এবং তাদের আকস্মিক রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তজনিত জটিলতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি। তবে আমদানি নির্ভরতা থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পেঁয়াজ আমদানির শুল্ক ৫ শতাংশ। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে এবং হঠাৎ বাজারের অস্থিরতা কমানোর স্বার্থে পেঁয়াজকে শুল্কমুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। শুধু বিপদে পড়ে নয়, প্রতি বছরই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। এই প্রণোদনা ততদিন চলতে পারে, যতদিন উৎপাদন ক্ষমতায় আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি। ভাত, ডাল, আলু, পেঁয়াজ এসব কিছুই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। এগুলোর সরবরাহ সঠিকভাবে আছে কিনা এবং সারা বছর থাকবে কিনা, তা চিন্তা করার জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব থাকতে হবে মন্ত্রণালয়গুলোতে। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, পেঁয়াজের অভাব পড়েছে আর তখন হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল, সাজ সাজ রব উঠল চারদিকে। তাৎক্ষণিকভাবে সবাই অস্থির হয়ে উঠল। সরকার প্রণোদনা নিয়ে হাজির হয়ে গেল। কিন্তু তারপরই সব চুপ। দামটা কমে গেলেই, প্রাপ্তিটা নিশ্চিত হলেই সবাই যেন একেবারে চুপ হয়ে যায়। এক বছর পর এ দিনটি যে আবার আসতে পারে, এমন চিত্র যেন আমাদের অভিধানে স্থান পায় না। অভিধানটা একটু পরিবর্তন প্রয়োজন। সারা বছরের চিন্তাই থাকতে হবে মাথায়। পেঁয়াজের ঝড় এলেই সবাই দৌড়ে যাব পেঁয়াজ ক্ষেতে এমনটা নয়। বরং উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সংরক্ষণ, সরবরাহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা এবং গবেষণা হতে হবে আমাদের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের অংশ। তবেই না পেঁয়াজের আর একটি ঝড় থেকে মুক্ত থাকতে পারব আগামী বছর এবং পরবর্তী বছরগুলো। মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App