×

জাতীয়

ডিজিটাল পাঠেও সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৭ এএম

বিপর্যস্ত মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা

কোভিড-১৯ এর কোপে পড়ে গত সাড়ে ৫ মাস ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মাধ্যমিক স্তরের ক্লাস যেমন বাতিল হয়েছে; তেমনি বাতিল হয়েছে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাও। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে দেয়া হয়েছে অটো প্রমোশন। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা কবে হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার যে রুটিন ছিল তা ভেঙে পড়েছে। সংকট উত্তরণে ডিজিটাল ক্লাস চালানো হলেও তা খুব একটা অর্থবহ হচ্ছে না। তবুও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের চাঙ্গা রাখতে জুম, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্লাটফর্ম ব্যবহার করে পাঠদান করছেন। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের ভাববিনিময় হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই সংকট সামাল দেয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংসদ টিভির মাধ্যমে সেরা শিক্ষকদের রেকর্ডিং করা ক্লাস প্রচার শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ ফেসবুক থেকেও ক্লাস সম্প্রচার শুরু করেন। কিন্তু এসব ক্লাস শহরের কিছু শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। অভিভাবকদের মধ্যেও সাড়া পড়েনি। তবুও ডিজিটাল ক্লাস কার্যক্রম চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ফলাফল প্রকাশের দুমাস পর চলতি সেপ্টেম্বরে একাদশ শ্রেণির ভর্তি প্রক্রিয়া শেষের পথে থাকলেও শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধই আছে। এতেও শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়েছেন।

জানতে চাইলে রাজধানীর নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা ভোরের কাগজকে বলেন, কোভিডের কারণে শুধু শিক্ষার্থীর নয়, শিক্ষকদেরও ক্ষতি হচ্ছে। সব পেশার লোকজন কাজে ফিরলেও এক শিক্ষাঙ্গনই এখন বন্ধ। তবু অনলাইন ক্লাস চালু রেখে এই ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এতেও সংকট আছে। তিনি বলেন, আগে হয়তো দেখা যেত সন্তানের হাতে মোবাইল থাকত না। কিন্তু এখন ঘরবন্দি অবস্থায় অনলাইনে ক্লাসে হাজিরার কথা বলে শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইল থাকছে। এতে ওই শিক্ষার্থী পড়াশুনার বাইরে অন্য বিষয়েও আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই আসক্তি শিক্ষার্থীর ওপর মানসিকভাবে প্রভাব পড়ছে। তার মতে, চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলে একটা দিশা পাওয়া যেত।

তবে সহসাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কিনা, কবে নাগাদ চলতি বছরের স্থগিত হওয়া উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়া হবে- এসব বিষয় জানাতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আজ বুধবার দুপুর ১২টায় শিক্ষাবিষয়ক সাংবাদিকদের সঙ্গে অনলাইনে মতবিনিময় সভা করবেন। তারপর মন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানাবেন। জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সাংবাদিকদের বলেন, এইচএসসি পরীক্ষা আয়োজন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খোলা হবে তা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। তাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যখন অনলাইনে ক্লাস করানো হচ্ছে, তখন শহরভিত্তিক একদল তরুণ-তরুণীর আবির্ভাব ঘটেছে। তারাও অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ‘প্রাইভেট টিউশন’ করাচ্ছেন। অনলাইনেই একেক বিষয়ে সিলেবাস শেষ করার নামে অভিভাবকদের কাছ থেকে নিচ্ছেন আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এই টাকা ক্লাসের শুরুতেই ‘বিকাশ’ করে দিতে হচ্ছে। শহরে যখন এই অবস্থা গ্রামে তখন এর লেশমাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ডিশ সংযোগ না থাকা, ইন্টারনেটের পর্যাপ্ততা না থাকা, ইন্টারনেট কিনতে টাকা না থাকা, বিদ্যুতের আসা যাওয়া, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনীহার কারণে গ্রামে অনলাইন ক্লাস সুফল বয়ে আনছে না। এতেও সংকট তৈরি হচ্ছে।

রাজধানীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক ভোরের কাগজকে বলেন, আমার দুই মেয়ে ভিকারুননিসায় পড়ে। কোভিডের কারণে স্কুল বন্ধ। পড়াশুনা তো আর বন্ধ হতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছেলেমেয়ে অনলাইনে প্রাইভেট টিউশনের একটি গ্রুপ করেছে। ওই গ্রুপের কাছেই আমার মেয়েরা পড়েছে এবং সিলেবাস শেষ করেছে। তবে শ্রীমঙ্গলের উদয়ন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির চা শ্রমিক শিক্ষার্থী জানান, বিদ্যুতের যাওয়া-আসার কারণে সংসদ টেলিভিশনে প্রচার হওয়া ক্লাস দেখতে পারিনি। পরে অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাস দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নেটের দুর্বলতার কারণে সেটাও দেখতে পারিনি। এর ফলে আমি আমার ক্লাসে পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়েছি।

এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর অন্যতম শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফৌজিয়া ভোরের কাগজকে অনলাইন ক্লাসের সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, এটিই বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে হবে। তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সংকট এতটাই গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে, যার ফলে বেশ কয়েকটি কারণে ভিকারুননিসার প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী গ্রামে চলে গেছে। এখন যারা শহরে রয়েছে তারা অনলাইন, জুম এবং ইউটিউব ক্লাস করে এগিয়ে আছে, আর যারা গ্রামে গেছে তারা এসব না পেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে। তবে সংকটই বলি আর অন্য কিছুই বলি, স্কুল বন্ধ থাকলেও কিন্তু পড়াশুনাটা ছিল। কিন্তু তাতে তো বৈষম্যও আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ তা তো আছেই। তবে এটা বিবেচনায় নিতে হবে, আগে আমার ছাত্রীর স্বাস্থ্য ভালো থাকতে হবে। সে যদি ভালো থাকে তাহলে তার লেখাপড়ার ক্ষতি আমরা পুষিয়ে নিতে পারব।

কী হবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার : গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা। কিন্তু করোনার কারণে পরীক্ষাটি এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এই পরীক্ষা নেয়া হবে। তবে এই পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষার্থীরা পড়েছেন ভয়ঙ্কর সংকটে। কারণ একই বই, একই অধ্যায় আর কত পড়বেন তারা। গত দুই বছর ধরে তারা এই পরীক্ষার জন্য বইটি পড়ে আসছেন। তারপর এপ্রিলে পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। এই হিসেবে গত এপ্রিল থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস ধরে একই পড়া পড়ে আসছেন। বারবার একই পড়া পড়তে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

জানতে চাইলে রাজধানীর কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আই কে সেলিম উল্ল্যাহ খন্দকার ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদেরই যেখানে খারাপ লাগছে, তাদের তো খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। তবে খারাপ লাগলেও তারা যেন কষ্ট করে বইগুলো বারবার পড়ে। এতে তাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাটা যেমন ভালো হবে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ভালো প্রস্তুতি হয়ে যাবে। তবে কোনো অবস্থাতেই চাপ নেয়া যাবে না। সবকিছু স্বাভাবিক মনে করে জীবন কাটানোর পরামর্শ দেন প্রবীণ এই শিক্ষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App