×

জাতীয়

অভিযানে থামেনি মাদক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১৩ এএম

অভিযানে থামেনি মাদক

মাদক। প্রতীকী ছবি

ধরাছোঁয়ার বাইরে গডফাদাররা আড়াই বছরে ৫৪৯ কারবারি বন্দুকযুদ্ধে নিহত, গ্রেপ্তার ৩ লাখ

২০১৮ সালের ১৫ মে সারাদেশে একযোগে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পর পেরিয়ে গেছে প্রায় আড়াই বছর। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও শহর বা গ্রামের কোথাও থামানো যায়নি মাদকের অবাধ প্রবাহ। অভিযানের শুরুতে একের পর এক বন্দুকযুদ্ধ ও গ্রেপ্তারে মাদক সরবরাহ কিছুটা কমে এলেও কয়েক দিন পরই তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বাহক থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের মাদক কারবারিরা ধরা পড়লেও গডফাদাররা থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কৌশল পাল্টে তারা ঠিকই অব্যাহত রেখেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার নিষিদ্ধ এই ব্যবসা। ফলে প্রতিনিয়তই সীমান্ত পেরিয়ে মাদক পৌঁছে যাচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। এমনকি করোনা মহামারিতে সব কিছু স্থবির হয়ে গেলেও মাদক কারবারিরা ছিল সরব। ওই সময়ে সারাদেশে চাহিদা মতো পৌঁছে গেছে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক। অনলাইন অর্ডার অনুযায়ী বাসায় পার্সেল পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে মাদক পাচারেও তৎপর হয়ে উঠেছে কারবারিরা। অভিযান শুরুর পর উত্থান ঘটেছে খাত, অ্যাম্ফিটামিনের মতো নতুন নতুন মাদকের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ অভিযানের নামে রুটিনমাফিক অভিযানে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের দ্বৈতনীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি চাহিদা কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। যার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। অভিভাবকরা যদি নিজের সন্তান ও স্বজনদের খেয়াল রাখেন এবং পুরো সমাজ মাদকের প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে ওঠে তাহলেই মাদক নির্মূল করা সম্ভব। না হলে বছরের পর বছর মাদকের প্রবাহ অব্যাহত থাকবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ১৫ মে থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৫৪৯ জন মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৫৫ জন, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৫৫ জন, বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৭৭ জন, ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৫৯ জন এবং বিজিবি ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে নিহত হয়েছে ৩ জন।

এদিকে ২০১৮ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সব সংস্থা (ডিএনসি, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড) মিলে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫২০টি মামলায় গ্রেপ্তার করেছে ৩ লাখ ৩ হাজার ১৪১ জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে ৬ কোটি ৫৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪৬ পিস ইয়াবা, ৬৫৯ কেজি হেরোইন, ২ কেজি কোকেন, ৬১ কেজি আফিম, ৭১ হাজার ১৮১ কেজি গাঁজা, ১৬ লাখ ৫ হাজার ৫৩ বোতল ও ২ হাজার ৫০১ লিটার ফেনসিডিল, ২ লাখ ৫ হাজার ২০২ বোতল ও ৩২১ লিটার বিদেশি মদ, ১ লাখ ৫১ হাজার ২৩৯ ক্যান ও ১ হাজার ৬০৮ বোতল বিয়ার এবং ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৫টি ইনজেকটিং ড্রাগ।

এর মধ্যে চলতি বছরের দুমাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ৪৮ লাখ ৭৯ হাজার ২৮২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর করোনার কারণে মার্চ থেকে মাদকবিরোধী অভিযানও স্তিমিত হয়ে পড়ে।

একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযান চলমান থাকলেও কারবারিরা রুট এবং কৌশল পাল্টে জল ও স্থলপথে সমানতালে দেশে প্রবেশ করাচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকের চালান। পরে পণ্যবাহী গাড়ি, পিকআপ, ট্রাক, বিমান ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সারাদেশে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, মাদককে একটি পণ্যের সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায়, চাহিদা ও সহজলভ্যতার কারণে এর বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। পাশাপাশি প্রযুক্তিও বিস্তার বাড়াতে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শুধু একটি ফোন কলে পৌঁছে যাচ্ছে মাদকের চালান। আর এই চাহিদা, সহজলভ্যতা আর প্রযুক্তিগত সুবিধার ফায়দা লুটছে মাদক কারবারিরা। ফলে এদের নিয়ন্ত্রণে আনা কখনোই সহজ কাজ নয়। যদিও সরকার দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করেছে। কিন্তু এ মাদকবিরোধী অভিযান ও আগের অন্য অভিযানগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, এ ধরনের রুটিনমাফিক অভিযানে কখনোই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

তৌহিদুল হকের মতে, সবার আগে মাদকের চাহিদা কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। নিজের সন্তান যেন বেপথে না যায় সেদিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। কোনো মাদকাসক্ত পুনর্বাসনের পর ফিরে এলে তাকে ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। এককথায়, সামাজিক অনুশাসনই পারে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে। প্রয়োজনে এ কাজে সমাজের মুরুব্বিদের যুক্ত করা যেতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদকমুক্ত দেশগুলোর একটাই নীতি দেশে কোনো মাদক উৎপাদন হবে না এবং প্রবেশও করবে না। আমাদের দেশেও সরকারের এরকম দৃঢ় পলিসি রয়েছে। এরপরও দেশের অভ্যন্তরে বার কালচার, মাদক সরবারহকারী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরে অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়া, সিগারেট বিক্রির মতো কার্যক্রম বহাল রয়েছে। এই জায়গাটিতে ‘ওয়ান স্টেপ নীতি’ না নিলে কখনোই মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেন্স) ডিআইজি এ এফ এম মাসুম রব্বানি ভোরের কাগজকে বলেন, মাদক ব্যবসা করে রাতারাতি মোটা অঙ্কের টাকা কামাই করে বড়লোক হওয়ার সুযোগই মাদকের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা। ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর মাদক উদ্ধার অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থাৎ মাদক সরবরাহ কমেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভিযান পরিচালনা করে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ জন্য শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। মানুষ যখন নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে পারবে তখন আর মাদক সেবন বা কারবারের সঙ্গে যুক্ত হবে না।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, চাহিদা না কমায় থামছে না মাদকের প্রবাহ। তবে মাদক সরবরাহ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বসে নেই। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে মাদক উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের আওতায় আনা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো মাদকের পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেপ্তার করা। এ বিষয়ে র‌্যাব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ের বড় বড় অভিযানগুলো লক্ষ্য করলেও স্পষ্ট হবে, পৃষ্টপোষক গ্রেপ্তার হয় বলেই বড় চালান ধরা পড়ে। এভাবে অভিযান অব্যাহত থাকলে মাদক একসময় নির্মূল হবেই বলে দাবি করেন র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন্স) ওয়ালিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের নিত্যনতুন কৌশলের কারণে মাদকের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে পুলিশ মাদক নির্মূলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আইজিপি প্রতিনিয়ত সব ইউনিটকে মাদক নির্মূলের বিষয়ে কঠিন বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। ডিএমপিও মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ তৎপর। পুলিশের পাশাপাশি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বা স্বজনদের খেয়াল রাখলে মাদক নির্মূল করা আরো সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App