×

মুক্তচিন্তা

করোনা বাণিজ্য ও নৈতিক অবক্ষয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:০৮ পিএম

গত মার্চ মাস থেকে করোনার তাণ্ডব শুরু হয়েছে। বৈশ্বিক এই মহামারির সময়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। করোনার কোনো কার্যকর চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সুরক্ষা সামগ্রীই যখন একমাত্র ভরসা তখন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী বা ‘পিপিই’ নিয়ে অবৈধ বা ভেজাল ব্যবসায় মেতে ওঠে। করোনা পরীক্ষার নামেও শুরু হয় ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর জালিয়াতি। শুধু নকল সুরক্ষা সামগ্রীই নয়, এসব নকল সুরক্ষা সামগ্রী অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি করেও হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। করোনা বাণিজ্যের ভয়াবহতা এতটাই অনৈতিক, অমানবিক ও নগ্ন হয়ে ওঠে যে, স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা না করেই ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়ার অভিযোগ ওঠে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে। রিজেন্ট ও জেকেজির মতো আরো অনেক হাসপাতালে এ রকম ভুয়া চিকিৎসা হচ্ছে বলে মনে করে সাধারণ মানুষ। মাস্ক দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে, যা অবিশ্বাস্য এবং হতবাক করে দেয়ার মতো ঘটনা। বাজারে চলমান হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বেশিরভাগই নকল বলে প্রমাণিত হয়েছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। নকল মাস্ক ও স্যানিটাইজার উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নকল বা ভেজালবিরোধী অভিযানে চিহ্নিত অভিযুক্তদের ‘জরিমানা’ নামক যে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় তা যথেষ্ট নয় এই কারণে যে, কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির পর লাখ লাখ টাকা জরিমানা দেয়া একজন অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য কোনো ব্যাপারই না। আর এসব অভিযান এখন অসৎ ব্যবসায়ীদের গা সওয়া হয়ে গেছে।

করোনা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রথমত নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার। এসব লোকের কোনো মানবিক বোধ নেই। আত্মস্বার্থমগ্ন এসব ব্যক্তি দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এরা অনেকেই আবার সমাজে পরিচিত। বিভিন্ন পদ-পদবির অধিকারী। সামনে পড়লে সাধারণ মানুষ এদের সমীহ করে চলে। পেছনে এদের ঘৃণা করে। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো মানুষ খুব কম। সাধারণ মানুষ সব সময় ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। প্রতিহিংসা আর পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে শান্তিপ্রিয় মানুষ এখন সব কিছু দেখে-শুনেও চুপ করে থাকে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য। সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি বাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে কমতে এখন শূন্যের কোঠায়। চোর-পুলিশ মিলে গেলে গেরস্থের যে দশা হয় সাধারণ মানুষের হয়েছে এখন সেই দশা। অবৈধ ও অনৈতিক ব্যবসায় ভরে গেছে দেশ। যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের পেছনে ছুটছে মানুষ। অর্থ এখন সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থ হলে সব হয়। সামাজিক সম্মান, দলীয় পদ, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি- সবকিছুর পেছনে এক মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠেছে। তাই অর্থের পেছনে ছুটছে মানুষ। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা কোটিপতি হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। ২০-২৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে খরচ করছে ৫০-৬০ হাজার টাকা। এদের সংখ্যাও দুই-একজন নয়; অসংখ্য। মূল্যবোধের অবক্ষয় এতটাই বেশি হয়েছে যে দুর্নীতিবাজদের এখন আর কেউ ঘৃণা করে না। দুর্নীতিবাজরা সামাজিক কাজে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সামাজিক সম্মান লুফে নিচ্ছে। সমাজের মেধাবী, বিবেচক ও মানবিক মানুষগুলো দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ বিত্তশালীরাই নানাভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে এদের সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা যাচ্ছে না।

করোনাকালে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধি ও আমলা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যেভাবেই হোক এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আখের গোছাতে হবে। তাই সব মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে বাণিজ্য করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। সরকারের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এরা সুকৌশলে অবৈধ বাণিজ্য করে যাচ্ছে। কোথায় এদের শক্তির উৎস? কোন সাহসে এরা এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে- ভাবলে অবাক লাগে।

এ ব্যাপারে প্রশাসনের যোগসাজশ আছে বলে জনমনে যে ধারণা সেটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও প্রায়ই অভিযুক্ত হয়ে থাকেন। অভিযোগ প্রমাণও হয় অনেকের বিরুদ্ধে। ভ‚তটা আসলে সর্ষের মধ্যেই। রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে কী করে একজন দুর্নীতিবাজ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন? ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ না হলে তো বহাল তবিয়তে দুর্নীতি করে যাওয়া সম্ভব নয়।

দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া নির্মূল করতে চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন দৃঢ়তার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন দুর্নীতি নির্মূল করতে না পারলে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ পাননি। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারেননি তিনি। দুর্নীতির সেই বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তার করে এখন সর্বগ্রাসী মহিরুহে পরিণত হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করুন না কেন- দুর্নীতি কোনোভাবেই কমছে না। করোনার মতো বৈশ্বিক সংকটকালে, এই মহামানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দেখা গেল করোনাবাণিজ্যের কী ভয়াবহ চিত্র। জীবন নিয়ে বাণিজ্য আর কতদিন চলবে? মানুষের কাছে মানুষের জীবন কি এতটাই মূল্যহীন!

আলী রেজা : কবি ও কথাসাহিত্যিক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App