×

মুক্তচিন্তা

প্রসঙ্গ মুক্তিযোদ্ধের রাষ্ট্রীয় সম্মান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০১ পিএম

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ২৪ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলায় সারাদেশের জনগণ আজ ক্ষুব্ধ। জনগণের দাবি, অবিলম্বে এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের সংসদ সদস্য পদ বাতিল ও আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হোক।

‘বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের সদস্য পদ বাতিল এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরের মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা।’ গত ১৭ সেপ্টেম্বর সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে ওই দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি উদ্বোধনকালে বক্তারা এ ঘোষণা দেন।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ২৪ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলায় সারাদেশের জনগণ আজ ক্ষুব্ধ। জনগণের দাবি, অবিলম্বে এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের সংসদ সদস্য পদ বাতিল ও আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হোক। জনগণের এ দাবি সরকার ও আওয়ামী লীগ কেন আমলে নিচ্ছে না, এজন্য সারাদেশের জনগণ হতবাক। মুক্তিযোদ্ধারা অবিলম্বে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানান।

মুক্তিযোদ্ধারা ওই সভায় বলেন, সংসদ সদস্যের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদকারী মৌলভী সৈয়দ আহমদের বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানায়নি। এর প্রতিবাদে ২৪ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনে হামলা চালান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজের সমর্থকরা।

সারাদেশেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থাও করেছে বর্তমান সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতেই এ এক রীতি আছে বাংলাদেশে এমনকি বাংলাদেশের বাইরেও। যারা মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে পৃথিবীর দেশে দেশে যারা অবদান রেখেছেন, তাদের মারা যাওয়ার পরও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্মান দেখানো হয়ে থাকে। যা ব্রিটেনে আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত কিংবা সহকারী রাষ্ট্রদূতরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে এ সম্মানটুকু দিয়ে থাকেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ যাত্রায়।

কিন্তু এই জায়গাটাতে মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননাটুকু দেয়া হয়নি বলে যে অভিযোগ উত্তাপন করেছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা তা কোনো লোকানো ব্যাপার নয়, খোদ প্রেস ক্লাবের সামনেই তারা এই অভিযোগ উত্তাপন করে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্থানীয় এমপির বহিষ্কার দাবি করেছেন। স্থানীয় এমপি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। অন্যদিকে যে মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান দেখানো হয়নি, তার ভাই এই জেলার বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী। সুতরাং তার কিংবা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ে কোনো চেতনাবিরোধী গন্ধ নেই। কিন্তু তারপরও শুধু এমপির রোষানলে পড়ে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা এমনকি তার সম্মানটুকু পাননি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা যে শুধু আওয়ামী ঘরানার মানুষই হতে হবে, তা তো নয়। যুদ্ধটা ছিল আপামর মানুষের। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশটা যুদ্ধ জয় করলেও ভিন্ন শ্রেণি-পেশা এমনকি ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ নিয়েও মুক্তির সেই সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে সেই যোদ্ধাদের কেউ কেউ ভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করলেও কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার মানুষ হয়ে গেলেও তাদের যুদ্ধের আত্মত্যাগটুকু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি সরকারের প্রধান প্রধান আসনগুলোতে বসা মানুষগুলো অতি দলীয় আনুগত্যে কিংবা কোনো ব্যক্তির প্রভাবে সরকারকেই সমালোচনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের অগোচরেই হয়তো আলোচিত হচ্ছে, সমালোচিত হচ্ছে সরকার।

এ রকম একটা ঘটনা ঘঠেছে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে। এবং এ নিয়ে বার্মিংহামের বাংলাদেশি রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব একটা ধুমায়িত হয়নি, তবে কমিউনিটিতে এ নিয়ে সোচ্চার হয়েছে মানুষ। ৮০ বছরের অধিক বয়সী একজন আলী ইসমাইল দীর্ঘদিন থেকে ব্রিটেনে বসবাস করে আসছিলেন। ৮ সেপ্টেম্বর তিনি বার্মিংহামে মারা যান। বাংলাদেশের উত্থানে ব্রিটেন প্রবাসী মানুষকে সংগঠিত করতে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে, ফান্ড সংগ্রহ করতে, পৃথিবীব্যাপী সমর্থন আদায় করতে আলী ইসমাইলের নাম বহু উচ্চারিত। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর খুব কাছের মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যেতে চাইলে ওসমানী তখন তাকে চিঠি দিয়ে (টেলিগ্রাম) নির্দেশ দিয়েছিলেন আলী ইসমাইল যেন ব্রিটেনেই থাকেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে, সমর্থন আদায় করতে কাজ করে যান। সেই আলী ইসমাইল স্বাধীনতা পরবর্তী মই মার্কা নিয়ে সিলেট-৬ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনও করেন।

আলী ইসমাইল প্রয়াত হওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনকে। কিন্তু আলী ইসমাইলকে বাংলাদেশের গৌরবময় পতাকায় জড়ানো হয়নি। অথচ এই ব্রিটেনে আমার বাস করা ম্যানচেস্টারে আমি নিজে উপস্থিত থেকেও দেখেছি, ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ উপাধি দিয়ে দুজন মানুষকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানো হয়েছে। তারা দুজনই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। প্রয়াত এ দুজনই আমার শ্রদ্ধেয়; তাদের মাঝে একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী পিআইএতে কাজ করতেন। তিনি শুধু চাকরি ছেড়েছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে, একসময় তিনি সাংবাদিকতা করতেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করতেন তিনি। অন্যজন ছিলেন ওই শহরের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব এবং ম্যানচেস্টার আওয়ামী লীগের সভাপতি সাজ্জাদ খান। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এর আগেও বার্মিংহামেরই প্রয়াত ইব্রাহিম আলী এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি লিডার কাউন্সিলর জানে আলমকেও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হয়েছে। জানে আলম বাংলাদেশে মারা গেলে তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়। এ দুজন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং এই দুজনই প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন।

বার্মিংহামের সম্প্রতি প্রয়াত এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আলী ইসমাইল একাধারে ছিলেন লেখক, রাজনীতিবিদ এবং কমিউনিটির প্রবীণ এক ব্যক্তিত্ব। সুতরাং সব সেক্টর থেকেই তিনি এ সম্মানটুকু পাওয়ার অধিকার রাখেন। অথচ স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা বললেন, আলী ইসমাইল তো মুক্তিযুদ্ধ করেননি। অবশ্য বার্মিংহামের সহকারী হাইকমিশনার স্থানীয় এক সাংবাদিককে বলেছেন, ‘এটা একটা রাষ্ট্রীয় প্রসেস এবং সময় স্বল্পতার কারণে তারা এ আয়োজন করতে পারেননি।’ অথচ দুজনের কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এবং এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে এখনো বার্মিংহামের বাংলাদেশি কমিউনিটি।

ব্যক্তিগত ক্রোধ কিংবা ঈর্ষা থাকতে পারে, রেষারেষিটাও থাকা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেক পথই অবলম্বন করে অনৈতিক মানুষগুলো। কিন্তু সর্বজনীন মুক্তিযুদ্ধ কোনো গোষ্ঠীর তো একার নয়। বঙ্গবন্ধুও শ্রমিক-ছাত্র-মজুর কিংবা ভিন্ন রাজনীতির মানুষগুলোকে যুদ্ধে যেতে প্রাণিত করেছেন। এবং তাঁর নির্দেশনায়ই যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এটা কোনো বাঙালি স্বপ্নে দেখেও অবিশ্বাস করতে পারবে না। বহু উচ্চারিত সেই মুক্তির সেনানিরা আমাদের গর্ব, আমাদের সর্বকালের অহঙ্কারের ভিত্তি। এই ভিত্তিটাকে সংকীর্ণতায় নিয়ে যাওয়া মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা। মনে রাখতে হবে, অস্বীকার করা ইতিহাস ফিরে আসে বারবার, নতুন রূপ নিয়ে, কখনো আরো ভয়ঙ্কর অসত্য নিয়ে। সুতরাং ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এই জায়গাটাকে অন্তত প্রশ্নবোধক যেন না করা হয়। ব্র্যাকেটবন্দি যেন না করা হয় সর্বজনীন বাঙালি জাতির এই গর্বের জায়গাটা।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App