×

সাময়িকী

নারী প্রগতিতে বিদ্যাসাগরের অবদান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০৪ পিএম

নারী প্রগতিতে বিদ্যাসাগরের অবদান

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বিধবা বিবাহ চালু প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দীর্ঘ এক পুরাণ পাঠের দিকে অগ্রসর হয়েছেন, পুস্তক রচনা করেছেন। শুধু যুক্তি দিয়ে নয়, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার দিকে মনোনিবেশ করেছেন বুঝেশুনেই। দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরেছিল বাঙালি হিন্দুসমাজ। প্রকৃত অর্থে বিদ্যাসাগরের পক্ষে হিন্দু পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে বিধবা বিবাহ চালুকরণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা কঠিন ছিল।

উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মে নয় শুধু অন্যান্য ধর্মেও মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেবার প্রথা পুরনো। এই প্রথা থেকে বের হবার জন্য বিদ্যাসাগরের চেষ্টা দেখবো ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে। নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন তেমনি নারী-পুরুষের প্রণয়ে বাল্যবিবাহ কীভাবে বাঁধ সাধে সে বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন। বিদ্যাসাগরের প্রেমবোধ পুণ্য পর্যায়ের। বলাবাহুল্য, বাল্যবিবাহ নিয়ে বাংলাদেশে আইন আছে কিন্তু এখনো প্রায় ষাট শতাংশ মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়। দেড়শো বছর আগে বিদ্যাসাগর পরিণত শরীরে পরিণত মন ও নারী-পুরুষের প্রণয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সংসারের কথা ভেবেছিলেন। এছাড়া একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শরীর যেমন করে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারে না তেমনই এদেশীয় সাংসারিক আচারও তো তার জন্য কম কঠিন কিছু নয়!

“মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল। সেই ঐক্য বয়স, অবস্থা, রূপ, গুণ, চরিত্র, বাহ্যভাব ও আন্তরিক ভাব ইত্যাদি নানা কারণের উপর নির্ভর করে অস্মদেশীয় পরস্পরের আশয় জানিতে পারিল না, অভিপ্রায়ে অবগাহন করিতে অবকাশ পাইলো না, অবস্থার তত্ত্বানুসন্ধান পাইল না, আলাপ পরিচয় দ্বারা ইতরেতরের চরিত্র পরিচয়ের কথা দূরে থাকুক একবার নয়ন সঙ্ঘটন হইল না, কেবল একজন উদাসীন বাচাল ঘটকের প্রবৃত্তিজনক বৃথা বচনে প্রত্যয় করিয়া পিতামাতার যেরূপ অভিরুচি হয় কন্যাপুত্রের সেই বিধিই বিধিনিয়োগবৎ সুখ দুঃখের অনুলঙ্ঘনীয় সীমা হয়ে রইলো।”

এই যে একে অপরকে না বুঝে সংসারের উৎপাদনে অংশ নিতে হয় এই প্রেমহীন অপরিপক্ব সম্পর্ক জীবনের আনন্দ থেকে নারী-পুরুষকে বঞ্চিত করে বৈকি। বিদ্যাসাগর যে প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে ওঠার পক্ষপাতী ছিলেন সম্ভবত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ এ সেই প্রেমই দেখিয়েছেন। হাজার বছর ধরে যে নারী অপ্রকাশ্য রেখেছিল তার মন ও শরীরকে বীরাঙ্গনায় সে নারীই বলতে পারলো তার শারীরিক চাহিদা আছে, সে যে পুরুষকে কামনা করে তার কাছে প্রেম নিবেদনেও পিছপা হলো না। এটাকে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের ফল বলা যেতে পারে কিন্তু অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, সোমের প্রতি গুরুপত্নী তারার প্রেম নিবেদনকে এই দেশের পূর্ণবয়স্ক, শিক্ষিত নারীর বহুদিনের আকাক্সক্ষার ফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। উল্লেখ্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বীরাঙ্গনা কাব্যটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছেন বিদ্যাসাগরের নারীভাবনার প্রতি যথোচিত খেয়াল রেখেই।

বিধবা বিবাহ চালু প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দীর্ঘ এক পুরাণ পাঠের দিকে অগ্রসর হয়েছেন, পুস্তক রচনা করেছেন। শুধু যুক্তি দিয়ে নয়, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার দিকে মনোনিবেশ করেছেন বুঝেশুনেই। দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরেছিল বাঙালি হিন্দুসমাজ। প্রকৃত অর্থে বিদ্যাসাগরের পক্ষে হিন্দু পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে বিধবা বিবাহ চালুকরণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা কঠিন ছিল। যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা থেকে কলিযুগের ত্রাতা পরাশরের বিধান পর্যন্ত উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন “স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম ত্যাগ করিলে অথবা পতিত হইলে স্ত্রীদিগের বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত।” তবু এসব উত্থাপন করে দেখানো প্রয়োজন ছিল যদিও বিদ্যাসাগর জানেন, “এক্ষণে ইহা বিবেচনা করা আবশ্যক ঐ সমস্ত ধর্মশাস্ত্রে যে সকল ধর্ম নিরুপিত হইয়াছে সকল যুগেই সে সমুদয় ধর্ম অবলম্বন করিয়া হইবেক কিনা।” এই প্রশ্ন সকল ধর্মের অধুনাব্যবহারের ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। বিধবা বিবাহের জন্য লেখালেখিই যথেষ্ট ছিল না আইন পাসের জন্য তিনি তৎপর ছিলেন। ৯৮৬ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত পত্র তিনি ভারত গভর্নমেন্টের কাছে প্রেরণ করেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে সত্য হলো বিধবা বিবাহের বিপক্ষে ৩ হাজারের অধিক স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিদ্যাসাগরবিরোধী এক দল হিন্দু ভারত সরকারের কাছে প্রেরণ করে। শুধু এই একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সহজে অনুধাবন করা যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কতটা প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে বিধবা বিবাহের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

আমাদের বলা প্রয়োজন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের আগেই কলকাতায় নারীশিক্ষা সমিতি স্থাপিত হয়েছিল, ১৮১৯ সালে। ১৮২২ সালের মধ্যে কলকাতায় মেয়েদের আটটি স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। শ্যামবাজারে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম মেয়েদের জন্য। পরের বছর কলকাতায় এই মহিলা স্কুলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২-এ। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা চিন্তার আগেও এদেশে নারীদের নিয়ে সমিতি, স্কুল ছিল কিন্তু বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষার রূপটি ভিন্ন। ১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগর ইন্সপেক্টর পদে নিয়োজিত হন। প্রথমেই তিনি লক্ষ করেন প্রকৃত অর্থে বালকদের শেখানোর জন্য উপযুক্ত পাঠ্যবই নেই। দ্বিতীয়ত, মেয়েদের আলাদা সিলেবাসে পড়ানো হয়। মেয়েদের গৃহকর্ম সম্পর্কিত শিক্ষা ব্যতীত বিশেষ কিছু নেই। অর্থাৎ মনে করা হতো ছেলেদের সিলেবাসে যে বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মেয়েরা তা পড়ার জন্য উপযুক্ত নয়। বিদ্যাসাগর দুটি কাজ করেন। কম্বাইন্ড স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ছেলেদের সিলেবাসে মেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে একজন শিক্ষাবিদ ও ইন্সপেকটর হিসেবে এই কাজ সম্পাদন করা কঠিনতর নয়। কিন্তু একই সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে যে বিশ্বাস ও বোধের জায়গাটিতে বিদ্যাসাগর নাড়া দিতে পেরেছিলেন সেটি হলো মেয়েরাও উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সমাজের নানাবিধ সংস্কার পার হওয়ার চেয়ে সহজে নানাবিধ কঠিন সিলেবাস আয়ত্ত করতে পারে। বিদ্যাসাগর প্রণীত যেসব পুস্তক পাওয়া যায় তার কোনোটিতেই তিনি ঈশ্বরবিষয়ক ধারণা দিতে চেষ্টা করেননি। এমনকি ‘বোধোদয়’র মধ্যেও তিনি কৌশলে ঈশ্বর প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন। ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থে বিনয় ঘোষ বিদ্যাসাগরের পাঠ্যক্রমে ঈশ্বর বিষয়ক প্রশ্ন বাতিল করে দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, “বাইরের সমাজে যখন ধর্মের নামে অধর্মের বন্যা বইছিল, তখন ধর্ম নিয়ে সামাজিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়াকে তিনি নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করেছেন।” নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে ধর্মবিষয়ক কথা বলার কারণ হলো ধর্ম নারীর শিক্ষা বিষয়ে চিরকালই নীরব ছিল, নেতিবাচক অবস্থানে ছিল। ধর্মকে তিনি গুরুত্ব দেননি, গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন এদেশের নারী শিক্ষিত হোক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App