×

জাতীয়

দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বিভ্রান্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৬ এএম

দেশে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ বা দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী শীতে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর আশঙ্কা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে। জাতীয় কমিটি বলছে এখনো প্রথম ধাপেই রয়েছে। তবে দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরু হয়েছে গত মার্চে। গতকাল পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে গত কয়েকদিন ধরে করোনা শনাক্তের হার কমেছে। এ নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও নীতি নির্ধারকরা শঙ্কামুক্ত নন। তবে করোনার তাণ্ডব থামবে তা নিশ্চিত নন কেউ। তবে এর সংক্রমণ যে দীর্ঘস্থায়ী হবে এ বিষয়ে নিশ্চিত বিশেষজ্ঞরা। কারণ যেসব দেশ ভাইরাসটিকে ইতোমধ্যে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল সেখানেও করোনার দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ ফিরে এসেছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা ‘দ্বিতীয় ঢেউ’। বিজ্ঞানীদের মতে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই। তবে বিষয়টি বোঝার জন্য এই সংক্রমণকে তারা সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন। সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণও ওঠানামা করে। এই ওঠানামার প্রতিটি ধাপকে বলা হয় ওয়েভ। সংক্রমণ শুরুর পর তা বেড়ে যখন কমে আসবে এবং কমে গিয়ে আবার তা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাড়তে থাকবে তখনই তাকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনার বিদায় হওয়ার এখনো অনেক বাকি। বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের থেকেও ভয়াবহ হচ্ছে। তবে প্রথম ধাক্কার অভিজ্ঞতায় যারা শিক্ষা নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে যেসব দেশ তারা দ্বিতীয় ঢেউয়ে নিজেদের সামলে নিয়েছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বিশ্বের অনান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণের বর্তমান অবস্থাকে বিশেষজ্ঞদের কেউ বলছেন প্রথম ওয়েভ। আবার কেউ বলছেন প্রথম পর্যায়ের শেষের দিকে। তবে এখনো যে দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ শুরু হয়নি সে বিষয়ে তারা একমত। কিন্তু গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ তা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের ভিত্তি খুঁজে পাননি কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন যে তথ্য জানাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সংক্রমণের হার কমছে। এখনো এই হার ১১/১২-এর মধ্যে আছে। বাড়ার খুব একটা আলামত দেখা যাচ্ছে না। এখনো সংক্রমণ প্রথম ঢেউয়ের মধ্যেই আছে। যখন এই সংক্রমণ আরো কমে গিয়ে আবার বাড়বে তখন বলা যাবে দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। তার মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে করোনার প্রথম ঢেউ দীর্ঘ হচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউ শুরুতে প্রতিরোধে করতে হলে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা এবং হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা এবং সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন মনে করেন দেশে এখনো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি। তিনি বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্তের হার ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। একে প্রথম ঢেউয়ের শেষ বলা যাবে না। মহামারি বিদ্যা অনুযায়ী করোনার শনাক্তের হার দৈনিক পাঁচ শতাংশের নিচে নামার পর কিছু দিন স্থিতিশীল থেকে ফের বাড়তে থাকলে তাকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হবে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক ড. এ এস এম আলমগীর মনে করেন, দেশে করোনার সংক্রমণ প্রথম পর্যায়ের শেষের দিকে রয়েছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণের হার এখন ১১ ও ১২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ সংক্রমণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসবে। তবে এখনো দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়নি। গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে শীতকালে সংক্রমণের হার বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সে দিন রাতে বৈঠকের পর জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বলেছে, সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হলেও এখনো হার স্বস্তিকর পর্যায়ে যায়নি। প্রতিবেশী ভারত বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বৈদেশিক যোগাযোগ উন্মুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশেও পুনরায় সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি, সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পূর্ণ প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। এছাড়া দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ দ্রæত নির্ণয় করতে সতর্ক থাকতে বলেছে। যেহেতু জীবিকার স্বার্থে লকডাউন সম্ভব নয়, তাই একটি কার্যকর টিকা না পাওয়া পর্যন্ত নিরাপদ থাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় বলে মন্তব্য করেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এই কমিটি। এর পরের দিন সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ সম্পর্কিত একটি বৈঠক হয়। একই বিষয়ে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, অর্থনীতিকে সচল রেখেই করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ সামলানো হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোকে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়েছে। এর আগে ২৮ আগস্ট কোভিড-১৯ নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির সঙ্গে অনলাইন সভা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। সভায় সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সভায় অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম বলেন, ‘সামনেই শীতের মৌসুম। অনেকেই ভাবছে শীতের সময় সেকেন্ড ওয়েব বা দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির মতামত কী এবং অধিদপ্তর এর জন্য কী করতে পারে? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যবিদরা জানিয়েছিলেন, এই পরিস্থিতির এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে সংক্রমণ কমানো যাবে। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন, সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App