×

জাতীয়

চারদিকে প্রতারণার ফাঁদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৫ এএম

চারদিকে প্রতারণার ফাঁদ

উপহার দেওয়ার নামে প্রতারণা করার অভিযোগে আটক এক কেনিয়ান ও দুই ক্যামেরুনের নাগরিক

চারদিকে প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছে প্রতারক চক্র। নানা অজুহাতে লোকজনের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ থেকে কোটি টাকা। চক্রে পুরুষদের পাশাপাশি রয়েছেন নারী, আছেন বিদেশিরাও। শহর থেকে গ্রামগঞ্জে বিস্তৃত তাদের জাল। মানুষ ঠকানো তাদের পেশা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালালেও প্রতারকদের অপকর্ম থামছে না। চাকরি দেয়া ও বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণা, বিয়ের নামে প্রতারণা, করোনার নমুনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা, জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রতারণা এমনকি বন্ধুত্বের নামেও চলছে প্রতারণা। সরল বিশ্বাসে হরহামেশা এমন প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। প্রতারকরা চম্পট দিলে কোনো সান্ত¡নায় থামছে না তাদের বোবা কান্না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে বহুমাত্রিক প্রতারণা দেখা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান উন্নত না হওয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে দুর্নীতি বেড়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এজন্য দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি যে অভিযান শুরু হয়েছে তার সুফল মিলতে শুরু করেছে। অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। পুলিশকে রিফর্ম করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো স্বাধীন করতে হবে। যারা ধরা পড়েছে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতে যে ধরনের অপরাধ হয়; এদেশেও সে ধরনের অপরাধ হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে প্রতারণার অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটছে। অভিযান অব্যাহত থাকলে এবং প্রতারকা ধরা পড়লে একপর্যায়ে তা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসতে পারে। জানা গেছে, ভুয়া করোনা পরীক্ষাসহ বহুবিধ প্রতারণা করে মো. সাহেদ নামে সাতক্ষীরার এক প্রতারক এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা করে ডা. সাবরিনা এখন কারাগারে। মাস্ক কেলেঙ্কারি করে কারাগারে আছেন শারমিন জাহান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। গত ২ বছরে তারা অন্তত ৬৫-৭০টি ভুয়া বা দ্বৈত এনআইডি কার্ড তৈরি করেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার জন্যই ভুয়া বা দ্বৈত এনআইডি তৈরি করা হতো। ব্যাংকঋণ পাস হলে সেই ঋণের ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিত চক্রের সদস্যরা। রিমান্ডের প্রথম দিনে এসব তথ্য জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের ২ কর্মীসহ প্রতারক চক্রের ৫ সদস্য। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ১২ সেপ্টেম্ব^র শনিবার রাতে মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোড এলাকার ডি-বøক থেকে নির্বাচন কমিশনের ২ ডাটা এন্ট্রি অপারেটরসহ প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর (৩২) ও আনোয়ারুল ইসলাম (২৬); ২ দালাল সুমন পারভেজ ও মজিদ। এছাড়া আবদুল্লাহ আল মামুন নামে এক ব্যক্তি নিজের নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ব্যাংকঋণ নিয়ে স্ত্রীর নামে আরেকটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়। এদিকে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার পর প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুলিশ ২৮ আগস্ট ১৫ জন নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে। সিআইডি কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রেপ্তারকৃতরা সামাজিক মাধ্যমে কখনো নারী বা কখনো পুরুষ সেজে আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষকে বন্ধু বানানোর পর উপহার দেয়ার লোভ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে গত ২ মাসে ৪০ জনের বেশি নাইজেরিয়ানকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিআইডি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের সবাই পুরুষ। কিন্তু তারা ফেসবুকে নারী সেজে পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন। তারা আমেরিকান সেনা বাহিনীর নারী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন। আবার নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে তারা পুরুষ পরিচয়ে তা করতেন। বন্ধুত্ব কিছুটা আবেগের জায়গায় পৌঁছালে তারা লোভ দেখিয়ে প্রতারণার জাল ফেলতেন। তারা কখনো আফগানিস্তান, কখনো সিরিয়ায় আমেরিকান সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধে রয়েছেন এমন সব পরিচয় দিয়ে বানানো বন্ধুদের বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে কাজের জন্য নিয়োগ দেয়ার কথা বলে স্যামসাং কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ‘ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট’ দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের ৫ সদস্যকে ৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বনানী ২৭ নং রোডের এ বøকের হাউস নং-৪৫ এর ৬ষ্ঠ তলা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণার মাধ্যমে সাড়ে ৩০০ চাকরি প্রত্যাশীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩ কোটিরও বেশি টাকা। চাকরি দেয়ার নাম করে ক্ষেত্র বিশেষে ১ জনের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে চক্রটি। তবে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পাওয়া কোরিয়ান কোম্পানি জানিয়েছে, ভুয়া নিয়োগপত্রের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এশিয়ান ট্র্যাভেলস এন্ড ট্যুরস নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি বা যোগাযোগ নেই। ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে কানাডার নাগরিক সেজে টানা ১০ বছর ধরে প্রতারণা করে আসা সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসকে (৩৮) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একদিনেই এই নারী পাত্রদের কাছ থেকে ৪০ লাখের বেশি টাকা তুলেছে। তবে কেউ জানত না কারো তথ্য। শতাধিক পাত্র তার শিকার হয়েছে। এই ব্যবসা করে সাদিয়া ৩০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে প্রতারক চক্রের মূল হোতা সাদিয়ার স্বামীসহ আরো ৪ সদস্য পলাতক। গত ১৭ সেপ্টেম্ব^র রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যব-৪ সদস্যরা ২১ সেপ্টেম্বর সোমবার রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া চাকরিদাতা ৩ প্রতিষ্ঠানের ১৪ প্রতারককে গ্রেপ্তার ও ৪৪ জন চাকরিপ্রার্থীকে উদ্ধার করেছে। সোমবার অভিযান চালিয়ে পল্লবীর ‘দিকরা সিকিউরিটি এন্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড, সেনপাড়ার আনোয়ারা লজিস্টিক এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড, আদাবরের আনোয়ার লজিস্টিক এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরিদাতা প্রতারক চক্রের ১৪ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার ও ৪৪ জন ভুক্তভোগী চাকরিপ্রার্থীকে উদ্ধার করা হয়। চট্রগ্রামে প্রতারক চক্র বেকার যুবকদের টার্গেট করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, এইচএসবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমন অভিযোগে চক্রের মূল হোতাকে গ্রেপ্তার করেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (বন্দর জোন)। ১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে প্রতারক ইব্রাহিমকে বন্দর নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন পাক্কা দোকান এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই প্রতারক চক্রের প্রতারণার জাল চট্টগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিস্তৃত ছিল। তারা শিক্ষিত, বেকার যুবকদের টার্গেট করে এসব অর্থ হাতিয়ে নিত। সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (বন্দর জোন) উপকমিশনার এস এম মোস্তাইন হোসেন জানান, ইব্রাহিম চাকরি দেয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়ার যে চক্র তার মূলহোতা। এই চক্র বেকার যুবকদের টার্গেট করে চাকরি দেয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। চাকরি দেয়ার নামে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজি এ কে এম শহিদুল হক বলেছেন, প্রতারণা থেকে বাঁচতে মানুষকে সচেতন হতে হবে। লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সজাগ হতে হবে। অল্প দিনে ধনী হওয়ার লোভ থেকে সরে আসতে হবে। সহজেই কিছু পাওয়ার আশা ত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতারণা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এজন্য মানুষকে সচেতন হবে হবে। এর বিকল্প নেই। র‌্যাব গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রতারণা থেকে বাঁচতে প্রথমে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে। সেটা অনলাইন এবং বাস্তব জীবনে। যে কোনো আর্থিক লেনদেনের পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে কোথায় কার কাছে টাকা যাচ্ছে। এছাড়া প্রতারণার ব্যাপারে সন্দেহ হলে দ্রæত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হতে হবে। প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App