×

সাময়িকী

অভীপ্সাটা ছিল সামাজিক বিপ্লবের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:৩৪ পিএম

অভীপ্সাটা ছিল সামাজিক বিপ্লবের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগর প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। রাজনৈতিক সংগঠন অবশ্য সে সময়ে তেমন ছিলও না। তবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন বসে কলকাতায়; দলের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মেলনে যোগদানের অনুরোধ করা হয়। বিদ্যাসাগর রাজি হননি। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন হলে কংগ্রেস কি তলোয়ার ধরতে পারবে? বোঝা যাচ্ছিল স্বাধীনতার জন্য যে সশস্ত্র অভ্যুত্থান প্রয়োজন হবে সেটা তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। ১৮৫৭-তে সিপাহি অভ্যুত্থান ঘটে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেনি। অনেকেই বিরোধিতা করেছে। কবি ঈশ্বর গুপ্ত তো সিপাহিদের নিয়ে রীতিমতো রঙ্গরসই করেছেন। বিদ্যসাগর নিশ্চুপ ছিলেন। সরকারি হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সরকারের আদেশে কোম্পানির সৈন্যদের থাকার জন্য কলেজ গৃহটি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তাতে নিশ্চয়ই তাঁর মনে ক্ষোভ জন্মেছিল। কিন্তু সেটা প্রকাশ করবার কোনো সুযোগ ছিল না। তলোয়ার যে ধরতে হবে সেটা বুঝে নিয়েছেন এবং কংগ্রেস যে ওপথে যাবে না, আবেদন-নিবেদনের পত্র নিয়ে শাসকদের দরবারে শুধু ঘোরাঘুরিই করবে এ তিনি জানতেন। আবার এটাও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়, বলেছেনও সে-কথা, যে কংগ্রেসওয়ালারা নিরন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, বিদ্যাসাগর নিজে যেমনটা দাঁড়াতে চেষ্টা করেছেন।

নিজের গ্রামে তিনি ছেলেদের স্কুলের পাশাপাশি বয়স্ক শ্রমজীবীদের জন্য সান্ধ্যকালীন স্কুল এবং মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র স্কুলও খুলেছেন। গ্রামে বন্যা, ম্যালেরিয়া ও দুর্ভিক্ষের উৎপাত ঘটেছে, বিদ্যাসাগর বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এসব কাজে কংগ্রেসের কোনো আগ্রহ ছিল না। কংগ্রেস স্বাধীনতার কথা বলেছে, কিন্তু যা চেয়েছে তা হলো ক্ষমতার হস্তান্তর। তারা ভারত যে বহুজাতির দেশ সেটা মান্য না-করে এক জাতির, নামান্তরে হিন্দু সম্প্রদায়ের, দেশ বলে উপস্থাপন করতে গিয়ে দ্বিজাতিতত্তে্বর জন্মকে সম্ভব করে তুলেছে। তাতে সুবিধা হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার, জাতীয়তাবাদী লড়াইটা বিভক্ত হয়ে গেছে; দাঙ্গা বেঁধেছে এবং শেষ পর্যন্ত দেশভাগের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এতসব বিপদ যে ঘটবে বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই তা আঁচ করেননি, কিন্তু কংগ্রেসের রাজনীতি যে দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন।

ইংরেজ শাসনকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। না-মেনে উপায় ছিল না। কিন্তু ইংরেজ শাসনকে যাঁরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করতেন বিদ্যাসাগর তাঁদের দলে কখনোই ছিলেন না। রামমোহন কিন্তু ছিলেন। ছিলেন না শুধু, ওই দলের নেতৃত্বই তাঁকে দিতে হয়েছিল। রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি বলে বিদ্যাসাগর যে রাজনীতি-নিরপেক্ষ ছিলেন তা মোটেই নয়। ইংরেজ শাসনে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না; সেটি মেনে নিয়ে যতোটা সম্ভব কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, শিক্ষার বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিস্তারে তিনি রাষ্ট্রীয় আনুক‚ল্যে সদ্ব্যবহার করেছেন মাত্র। জানতেন যে তা না করলে কাজ হবে না। কিন্তু তাঁর মূল কাজটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়েই পড়ে। সেই কাজটা ছিল মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা। এটা ইংরেজ শাসকরা চায়নি। তারা চেয়েছিল ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষা চালু করে তাদের সহযোগী ও ব্যবহারের উপযোগী একটি তাঁবেদার শ্রেণি তৈরি হোক। বিদ্যাসাগরের অভিপ্রায় ও কাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের ওই ইচ্ছার বিরোধটা ছিল একেবারেই মৌলিক।

বিদ্যাসাগর জাতীয়তাবাদী ছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তিনি ভারতবর্ষের কথা বলেছেন, কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিকতা বৈ নয়; তাঁর নিজের প্রকৃত পরিচয় ও অবস্থান ছিল বাঙালি হিসেবেই। বাঙালি বলতে বোঝায় বাংলাভাষা ব্যবহারকারী এবং বাঙালির উন্নতির জন্য ব্রতী মানুষ। উভয় গুণই চাই। বিদ্যাসাগর ওই দুই গুণে গুণান্বিত অর্থেই বাঙালি ছিলেন। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তত তিনটি বড় অসম্পূর্ণতা ছিল। তিনটিই বৈষম্যজনিত; যথাক্রমে লৈঙ্গিক, শ্রেণিগত ও সাম্প্রদায়িক। বৈষম্য ছিল নারী ও পুরুষে, বিদ্যাসাগরের জন্য উভয় গুণই চাই। সবচেয়ে পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। বৈষম্যটা খাড়াখাড়ি বিভাজনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগর কাজ করছিলেন এই বিভাজনের অবসান ঘটিয়ে নারী ও পুরুষকে একই স্তরে নিয়ে আসবেন যাতে নারীরা পুরুষের সমান হয় এবং নারী ও পুরুষ একত্রযোগে সমাজকে সমৃদ্ধ ও সুখী করার লক্ষ্যে কাজ করতে পারে। এর জন্যই তিনি কাজ করছিলেন। দ্বিতীয়, এবং আসলে প্রধান ছিল, আড়াআড়ি শ্রেণিবিভাজন। শ্রেণিবৈষম্য দূরত্ব ঘোচাবার জন্য যে রাজনৈতিক আন্দোলন প্রয়োজন সেটা তখনও গড়ে ওঠেনি। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা বিদ্যাসাগরের জন্মের একশ পরের ঘটনা। সম্প্রদায়ের ব্যবধানটা বিদ্যাসাগরদের কাছে দৃশ্যমান ছিল না, কারণ সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তখনও দৃশ্যমান হয়নি। তারা তখন একে দরিদ্র তদুপরি আধুনিক শিক্ষার প্রতি বিমুখ। তদুপরি সেটি ছিল সাম্প্রদায়িক হিন্দু কলেজের যুগ, অসাম্প্রদায়িক প্রেসিডেন্সি কলেজের দ্বারোদ্ঘাটন তখনও ঘটেনি। মুসলমান সম্প্রদায় অপেক্ষা করছিল শিক্ষার এবং অর্থনৈতিক আত্মপ্রতিষ্ঠার। রাষ্ট্র তাদের অপ্রীতির চোখে দেখতো।

এক কথায় বিদ্যাসাগর যে লক্ষ্যে কাজ করছিলেন সেটা হলো সামাজিক বিপ্লবের জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই প্রস্তুতির প্রয়োজনেই তাঁর বাংলা গদ্যকে প্রাণবন্ত, প্রবহমান ও সুষমামণ্ডিত করে তোলা। একই প্রয়োজনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন নারীমুক্তিকে সম্ভব করবার এবং গণশিক্ষা বিস্তৃতকরণের কাজে।

২ কিন্তু তারপর? সাফল্য কতটুকু? বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গতেই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না’। সেটা কি বিদ্যাসাগরের বেলাতেও প্রযোজ্য? আরম্ভ করেছেন, শেষ করেননি? দেখলেন পারবেন না; সে জন্যই কি কলকাতা থেকে দূরে সাঁওতাল পরগণাতে গিয়ে জমি কিনে বাগানবাড়ি তৈরি করে সাঁওতালদের ভেতর থাকা শুরু করেছিলেন? মানববিদ্বেষীই কী হয়ে পড়েছিলেন শেষমেশ?

না, মোটেই না। বিদ্যাসাগর মানববিদ্বেষী হবার মানুষ ছিলেন না। তবে এটা বুঝেছিলেন যে যাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছিলেন তাদের নিয়ে আর এগুতে পারবেন না। অনেকেই পিছিয়ে গেছে, কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা পর্যন্ত করেছে। বিধবা বিবাহের প্রবর্তনের জন্য অনেকটা সময় শ্রম ও টাকা খরচ করলেন, কিন্তু দেখলেন বিধবা বিবাহের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৬০টি। তাঁর একমাত্র পুত্র যখন একজন বালিকা বিধবাকে বিয়ে করার উদ্যোগ নেয়, তখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখলেন সেই পুত্র নানা রকমের অপকর্ম করছে। বিদ্যাসাগরের রাগ ছিল, রাগ তো আসলে অনুরাগেরই উল্টোপিঠ; পুত্রকে তিনি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। বলা যায় ত্যাজ্যই করে দিলেন। বিদ্যাসাগরের পিতা চলে গেছেন কাশিতে, বিদ্যাসাগর সেখানে যাবেন কি? প্রশ্নই ওঠে না। মা থাকেন গ্রামে, বিদ্যাসাগর গ্রামেও যাবেন না, গ্রামীণ মধ্যবিত্তকেও তাঁর চেনা হয়ে গেছে; মা’কে এনে নিজের কাছে রাখবেন, মা যদি সম্মত হন। অন্য পরিবারের মেয়েদের তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েছেন, নিজের স্ত্রীকে দিতে পারেননি; এমনকি নিজের মেয়েদেরও নয়। অভিমান অন্যের ওপরে ছিল। নিজের ওপরে যে ছিল না তাও নয়। অভিমানে তিনি পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন, যদিও উইল করে কে কতটা পাবে সেটা ঠিক করে দিয়েছিলেন।

এই বিচ্ছিন্নতা তাঁর একার নয়। সমাজেই সেটা ঘটছিল। পুঁজিবাদ বিকশিত হচ্ছিল। তবে শিল্প উদ্যোগের ভেতর দিয়ে নয়, প্রায় সবটাই জমিদারি ব্যবস্থা, ব্যবসা ও চাকরির মাধ্যমে। বিদ্যাসাগরের বন্ধু ও সহকর্মী মদনমোহন তর্কলঙ্কার তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’ বইতে লিখেছিলেন “লেখাপড়া যেই জানে/ সর্বলোকে তারে মানে”; একই বইতে আবার এই কথাটাও ছিল, “লেখাপড়া করে যেই/ গাড়ীঘোড়া চরে সেই”। দু’টির মধ্যে তফাৎ এই যে প্রথমটি সামাজিক, দ্বিতীয়টি পুঁজিবাদী। লোকের কাছ থেকে মর্যাদা পাওয়া এবং একাকী বড়লোক হওয়া, এই দুই ধারণাই যে তখন চালু ছিল সেটা বিলক্ষণ বোঝা যায়। কিন্তু ওই দুই ধারণা এক সঙ্গে থাকেনি, পারেনি থাকতে, বিদ্যার সামাজিক স্বীকৃতির ব্যাপারটাকে সরিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদী আকাক্সক্ষাটা এগিয়ে গেছে। লেখাপড়া শিখে সামাজিক মর্যাদার লাভের তুলনায় ব্যক্তিগত মুনাফা সংগ্রহই বড় হয়ে উঠেছে, গাড়িঘোড়ায় চেপে পারলে অন্যকে চাপা দেবার লোভটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বাস্তবতা বিদ্যাসাগরের সময়ে ছিল। বিদ্যাসাগর সামাজিক অগ্রগতির জন্য লড়ছিলেন, কিন্তু দেখা গেল সমাজে ব্যক্তিগত অগ্রগতিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এর কারণে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন। মর্মবেদনায় আহত অবস্থাতেই তিনি লিখেছেন,

‘এদেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তিবিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাতপুরুষ মাটি তুলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে তবে এদেশে ভালো হয়।’ সেই নতুন মানুষ তাঁর চারপাশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পাবেন এমন ভরসা খুইয়ে তবেই তিনি সাঁওতালদের সান্নিধ্য খুঁজতে বের হয়েছেন। না, কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করতে পারেননি, আয়-উপার্জন ও বণ্টনের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু পছন্দ ছিল সরল ও মেহনতী মানুষদের সান্নিধ্যে। সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল ১৮৫৫-তে; সেই বিদ্রোহ দমনে কেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনারা নয়, বাঙালি ও বিহারি ব্যবসায়ী ও আমলারাও তৎপর ছিল। বিদ্যাসাগর বিদ্রোহ-করা সেই সাঁওতালদের কাছেই গেলেন। পারলে কৃষকের কাছে যেতেন, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না, যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক ছিল মধ্যবিত্তের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বেষ্টনী।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় বুর্জোয়া বিকাশের ভেতর দু’টি বিশেষ উপাদান উপস্থিত ছিল। উপাদান দু’টি পরস্পরবিরোধী দু’টি ধারার রূপ নেয়। একটির প্রতিনিধি বিদ্যাসাগর অপরটির প্রতিনিধি বঙ্কিমচন্দ্র। বিদ্যাসাগরের ধারা ধর্মনিরপেক্ষতার বঙ্কিমচন্দ্রের ধারাটি ধর্মের কাছে প্রত্যাবর্তনের। রামকৃষ্ণ পরমহংসের কর্মকাণ্ডও ছিল ওই ধারাতেই। বঙ্কিমচন্দ্র সংগ্রামের শিক্ষা দিয়েছেন, পরমহংস শিক্ষা দিয়েছেন বৈরাগ্যের। দুটোই কিন্তু পুঁজিবাদী ঘরানার। বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তির উন্নতি ঘটাতে চান সম্প্রদায়ের শক্তিকে বাড়িয়ে; পরমহংস বলেন ব্যক্তিগত সাধনার সিঁড়ি বেয়ে ঈশ্বরানুভ‚তির গন্তব্যে পৌঁছার কথা। ব্রাহ্ম ধর্ম এসেছিল; সেও হিন্দু ধর্মেরই অংশ; এবং শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেছে তার ভেতরেই। বিদ্যাসাগরের ধারাটি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটি ধর্মনিরপেক্ষতার, এবং চ‚ড়ান্ত বিচারে সামাজিক বিপ্লবের। নিজের সমস্ত জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির অর্জনকে সঙ্গে নিয়ে এবং শ্রেণিচ্যুত হয়ে বিদ্যাসাগর সাঁওতালদের কাছে গিয়েছিলেন। গিয়ে বৈরাগ্যের সাধনা করেননি, কাজ করেছেন সামাজিক। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে, বাঙালিদের বিষয়ে, রবীন্দ্রনাথের আরেকটি আক্ষেপ ছিল; ‘আমরা আড়ম্বর করি, কাজ করি না’। বিদ্যাসাগর তার প্রতিক্রম ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন। সাঁওতাল পরগণায় গিয়ে নিজের জমিতে কেবল ফুল ও ফলের চাষই করেননি, সাঁওতালদের মিত্র হিসেবে বিদ্যালয় খুলেছেন, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিয়েছেন, বিপদে আপদে পাশে থেকেছেন, তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন; নিজে একজন তথাকথিত আদিবাসী হয়ে যাবেন বলে নয়, পশ্চাৎপদ কিন্তু সরল ও সংগ্রামী জনপদে নতুন মানুষের চাষ করা যাবে এই আশাতে।

অত বড় ব্যতিক্রমী মানুষ বিদ্যাসাগরের পারা না-পারাটা তাঁর নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, আমাদের সমষ্টিগত ইতিহাসের ব্যাপারও। তাঁর না-পারা সমাজেরই না-পারা। কিন্তু তিনি তো আছেন। সমাজ-বিপ্লবের পক্ষে তাঁর সাংস্কৃতিক কাজের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টান্ত উত্তরসূরিদের জন্য রেখে গেছেন। কাজটা সম্মিলিত। তার জন্য অঙ্গীকার চাই, বোঝা চাই যে সমষ্টির মুক্তি না ঘটলে ব্যক্তির মুক্তি অসম্ভব। পরিবর্তনের কর্মীদের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে জ্ঞানের অব্যাহত অনুশীলন ও বিতরণ এবং একই সঙ্গে আবশ্যক শ্রেণিচ্যুতি, যার অর্থ ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সমষ্টির স্বার্থের মিলন ঘটানো।

বিদ্যাসাগরের সকল কাজের ভেতর অন্তর্গত কেন্দ্রীয় অভীপ্সাটা ছিল সামাজিক। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধিতে তাঁর আগ্রহ ছিল না, তিনি অস্থির ছিলেন সমাজের দুর্দশার কথা ভেবে। চিন্তা ছিল সমাজকে কীভাবে বদলানো যায় তা নিয়ে, সেটা না বুঝলে তাঁকে পরিপূর্ণভাবে বোঝার উপায় নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App