×

মুক্তচিন্তা

সবার অগোচরে অর্থবিত্তের বৈভব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:০২ পিএম

একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে কারো কারো সবার অগোচরে অধিকতর অর্থবিত্তের বৈভব বৃদ্ধির সাম্প্রতিক সন্ধান স্বাস্থ্য বিভাগের গাড়িচালকের কাহিনী। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ধনী হওয়ার ক্ষেত্রে, এমনকি বড় বড় দেশকে টপকিয়ে মহাদেশে সেরা হওয়ায় আনন্দ সর্বনাশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ অবশ্যই রয়েছে। সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্রুত (commitment) ও দৃঢ় চিত্ততার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও সঙ্গে সঙ্গে এসে যায়। নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আদিষ্ট হয়ে, প্রশ্রয়ে, প্রযত্নে যদি সাগর চুরির মতো কর্মধারা পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভ‚মিকা পালনের দায় এড়াতে পারে না। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতাহীনতায় আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে পরিবেশ-পরিস্থিতি, বিশেষ করে উদঘাটিত মহাডাকাতি, ব্যাপক অনিয়মের প্রতিবিধান, প্রতিকার ও বিচার ব্যবস্থাপনার ফলাফল যদি দৃশ্যগোচর করে আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ না থাকে তাহলে স্বেচ্ছাচারিতার অবাধ অজুহাত ও যৌক্তিকতার তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। পাবলিক সার্ভিসে প্রতিটি কর্মকর্তার নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পরিপালনের মাধ্যমে একটা স্বচ্ছ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ থাকার দরকার। যারা নীতি প্রণয়ন করে, নীতি উপস্থাপন করে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃঢ়চিত্ততা এবং নীতি-নিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। তা না হলে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা পায় না স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা আসে না। সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা প্রয়োজন সবার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সর্বোপরি উন্নয়নেরই স্বার্থে। কারণ এটা পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয় নীতি-নির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে, তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করিয়ে নিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ক্ষেত্রে তাদের নানান সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রত করতে পারেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, মাঠ ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধরনের অব্যবস্থাপনার ও আত্মসাতের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে কমবেশি ছিল বা আছে, তবে তা মাত্রা অতিক্রমণের ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যাতে প্রতিভাত না হয় সেটা দেখা দরকার। উন্নয়নশীল থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে আছে এমন দেশ বা অর্থনীতিতে কতিপয়ের অস্বাভাবিক অর্থপ্রাপ্তি বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম উপসর্গ, উৎসাহ ও পরস্পর প্রযুক্ত প্রেরণা। নানান আঙ্গিকে পরীক্ষা-পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক-চিকিৎসক-আইনজীবী-ব্যবসায়ী এমনকি চাকরিজীবীদেরও বাঞ্ছিতভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয় না। প্রতীয়মান হয় অতিমাত্রায় কোটারি, সিন্ডিকেট বা দলীয়করণের কারণে পেশাজীবী, সংস্থা সংগঠন এবং এমনকি সুশীল সেবকরাও প্রজাতন্ত্রের হয়ে দল-নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে তাদের হিমশিম খেতে হয়, গলদঘর্ম হতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয় যার ছত্রছায়ায় নানানভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের পথ সুগম হতে পারে। সেবক প্রভুতে পরিণত হলে সম্পদ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা অর্জিত অর্থ দখলের লড়াইও অর্থায়িত হয় এভাবে একটা ঘূর্ণায়মান দুষ্টচক্র বলয় তৈরি হয়ে থাকে। অর্থাৎ সুশাসনের অভাবে স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় ঘুরেফিরে পুরো প্রক্রিয়াকে বিষিয়ে তোলে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার প্রয়োজন গণতন্ত্র ও সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুশাসন স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে সত্যিকার উন্নয়ন টেকসই হয় না। এটা পরস্পরের পরিপূরক। স্বচ্ছতার অস্বচ্ছতায় যে উন্নয়ন হয় তাতে জনগণের সুফল নিশ্চিত হয় না। এ উন্নয়নের কার্যকর কোনো উপযোগিতা বা রিটার্ন নেই। এটা এক ধরনের আত্মঘাতী ভেল্কিবাজিতে যাতে পরিণত না হয় সেটা দেখা দরকার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, ধরা যাক ৪০০ কোটি টাকা। সেটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করার কথা এবং বরাদ্দ সেভাবেই দেয়া আছে। কিন্তু সড়কটি শেষ করতে যদি ১০ বছর লেগে যায় এবং ৪০০ কোটি টাকা খরচের জায়গায় দ্রব্যমূল্য ও নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে যদি প্রায় ১২০০ কোটি টাকা খরচ করতে হয় সেটা তো সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দুর্বল পরিস্থিতিরই পরিচায়ক। আলোচ্য অর্থ দিয়ে একই সময়ে হয়তো আরো দুটি সড়ক করা যেত। সময়ানুগ না হওয়া এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তিনটা সড়কের অর্থ খরচ করে একটা সড়ক নির্মিত হয়েছে। আরেকটি বিবেচ্য বিষয় সড়কটি যথাসময়ে নির্মিত হলে (৩ বছর) পরিবহন খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উপযোগিতা সৃষ্টি হয়ে জিডিপিতে অবদান রাখতে পারত। যথাসময়ে নির্মাণ উত্তর প্রাপ্য সেবা ও উপযোগিতার আকাক্সক্ষা হাওয়া হয়ে যাওয়ায় প্রাপ্তব্য উপযোগিতা মেলেনি যথাসময়ে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল কথা হলো যে অর্থই ব্যয় বা বিনিয়োগ করা হোক না কেন সেই আয়-ব্যয় বা ব্যবহারের দ্বারা অবশ্যই পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতে হবে। পণ্য ও সেবা উৎপাদনের লক্ষ্যে যে অর্থ আয় বা ব্যয় হবে সেটাই বৈধ। আর যে আয়-ব্যয় কোনো পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে না সেটা অবৈধ, অপব্যয়, অপচয়। জিডিপিতে তার থাকে না কোনো ভ‚মিকা। আরো খোলাশা করে বলা যায় যে আয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের মাধ্যমে অর্জিত হয় না এবং যে ব্যয়ের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় না সেই আয়-ব্যয় জিডিপিতে কোনো অবদান রাখে না। কোনো প্রকার শ্রম বা পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া মওকা যে আয় তা সম্পদ বণ্টন বৈষম্য সৃষ্টিই শুধু করে না সেভাবে অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ধার ধরা হয় না। ফলে তা সৃষ্টি করে আর্থিক বিচ্যুতি। এভাবে যে অর্থ আয় বা খরচ করা হয় তা প্রকারান্তরে অর্থনীতিকে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে। রাষ্ট্রের একেকটি দপ্তর এবং তার কর্মবাহিনীর একেকজন সদস্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা আছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনে আত্মস্বার্থসিদ্ধি তথা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিলে দপ্তরের ওপর অর্পিত সেবামূলক কাজ কিংবা সম্পদ উৎপাদন হয়ে পড়তে পারে সুদূরপরাহত। দায়িত্ব পালনের নামে অর্জিতব্য রাজস্ব লোপাট হলে পারিশ্রমিক পরিশোধ বা রাষ্ট্রের ব্যয় বা দায় বাড়া সত্তে¡ও রাষ্ট্রের রাজস্ব বা সেবা বা আয় না বাড়লে ডেফিশিট বাজেটিংয়ের অনিবার্য পরিস্থিতি তো সৃষ্টি হবেই। ব্যক্তির সংসারে ঘাটতি অর্থনীতির যে যন্ত্রণা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তা ব্যাপক বিড়ম্বনার কারণ। নুন আনতে পান্তা ফুরাবার অর্থনৈতিক অবস্থায় সবার সুচারু ভ‚মিকা পালন যেখানে অনিবার্য বা সেখানে দায়িত্বহীন আচরণেও দুর্নীতির খপ্পরে পড়ার অবকাশ নেই। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। তেল আনতে নুন ফুরায় যে সংসারে সেখানে সমৃদ্ধির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সমস্যারা পরস্পরের মিত্র একটার সঙ্গে একটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয় উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকরণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয় উপার্জনের ন্যায়নীতিনির্ভর সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে, কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটাকে উপেক্ষা মানে যুগপৎভাবে অন্যান্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেয়া। সমস্যার উৎসে গিয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, এ কাজ সবার। সমস্যার মোকাবিলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। পাহাড় সমান অনিয়ম প্রতিকার প্রতিবিধানে যে কোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টিতে, আস্থা আনয়নে ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র সমন্বয়ে দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। সমন্বয়ে সবাইকে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হলেও কর্মভাবনায় বিচ্যুতির আভাস যেন না মিলে। সমন্বিত উদ্যোগে উন্নয়নে দ্বিধান্বিত হওয়া দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী বশংবদ বেনিয়া মুৎসুদ্ধি মানসিকতার সঙ্গে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App