×

মুক্তচিন্তা

ইউরোপীয় ক্লাব হোক ‘প্রীতিলতা স্মৃতি জাদুঘর’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৫৪ পিএম

ইউরোপীয় ক্লাব হোক ‘প্রীতিলতা স্মৃতি জাদুঘর’
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ ব্যক্তিত্ব মাত্র ২১ বছর বয়সে যিনি তৎকালীন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সারা ব্রিটিশ রাজশক্তির ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, গতকাল ছিল সেই বীর প্রসবিনী চট্টলার বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৮৮তম প্রয়াণ দিবস। ৫ মে, ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করা এ বীরকন্যা বেড়ে ওঠে চট্টগ্রাম জেলার বর্তমান পটিয়া থানার অন্তর্গত ধলঘাট গ্রামের মামার বাড়িতে। ৬ ভাইবোনের মধ্যে ছিল প্রীতিলতা দ্বিতীয়। পড়াশুনায় গভীর মনোযোগী ডা. খাস্তগীর স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সময় প্রীতিলতার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বীর নারীদের জীবনী পড়তে দিতেন। ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট চাঁদপুরের তারিনী মুখার্জি হত্যা মামলায় রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ঢাকায় ১৯২৮ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ইংরেজদের আচরণে প্রীতিলতা খুবই মর্মাহত হন এবং ইংরেজদের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কিছু একটা করার লক্ষ্যে উদীপ্ত হন। ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারণে সেদিনের ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী রেলস্টেশনের কাছে এ ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড়তলীর এ ক্লাবের চারদিকে প্রহরী বেষ্টিত ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা ব্যতীত এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয়দের ওই ক্লাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ক্লাবের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল, ‘ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড’। সন্ধ্যা থেকেই ইংরেজরা এ ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ-গান ও আনন্দ উল্লাস করত। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য ১৯৩২ সালের ১০ আগস্ট শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ৭ জনের একটা দল নতুনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু ওই দলও ব্যর্থ হয়। এরপর মাস্টারদা ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিপ্লবী কল্পনা দত্তের নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ৭ দিন আগে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হলে দায়িত্ব পড়ে প্রীতিলতার ওপর। এজন্য চৌকশ ও সাহসীদের নিয়ে ৭ জনের একটা দল গঠন করা হয়। কাট্টলীর সমুদ্রতীরে প্রীতিলতাসহ অন্যান্য বিপ্লবী আক্রমণকারীকে যথাযথ অস্ত্রশিক্ষা দেয়া হয়। রাত ১০টা ৪৫ মিনিট। পুরুষবেশী প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি, চুল ঢাকা দেয়ার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। অন্যদের পোশাক ছিল ধুতি, শার্ট ও লুঙ্গি। ক্লাবের একজন বাবুর্চির সহায়তায় বিপ্লবীরা আগেভাগেই সব খবর পেয়েছিলেন বিধায় রিভলবার, রাইফেল, বোমা ও ভেজালি নিয়ে দলনেতা প্রীতিলতার বাঁশির হুইসেল শোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করেন। ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব প্রচণ্ড কেঁপে উঠছিল। ক্লাব ঘরের সব বাতি নিভে যাওয়ার কারণে অন্ধকারের মধ্যে প্রায় ৪০ জন ইউরোপিয়ান ছোটাছুটি করতে লাগল। সফলভাবে অভিযান শেষ করে দলের নেতা হিসেবে প্রীতিলতা সবাইকে বের করে নিজে বের হলেন শেষে। সবাই নির্বিঘ্নে চলে গেলেন। হঠাৎ ক্লাবের ভেতর থেকে একটা গুলি এসে প্রীতিলতার বুকে লাগে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে অপমান ও লাঞ্ছিত হতে হবে। তাই রক্তাক্ত অবস্থায় দলের সবাইকে নিরাপদে পাঠিয়ে দিয়ে শত্রæর হাতে বন্দি এড়াতে ‘সায়ানাইড’ (বিষ) খেয়ে আত্মাহুতি দেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এ আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন মহিলা নিহত হন এবং ৪ পুরুষ ও ৭ নারী আহত হন। আজ বড়ই দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পুরো ভারতবাসীর মুক্তির জন্য যে সাহসী মেয়েটি আত্মাহুতি দিলেন, সে প্রীতিলতাকে আমাদের প্রজন্মই ভালো করে চিনে না আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা কী বলব? আমরা আমাদের সন্তানদের কোনোদিন জানাতে চেষ্টা করিনি যে, ইউরোপিয়ান ক্লাবে ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’ এর বিরুদ্ধে লড়াই করে আত্মাহুতি দিয়েছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নামক বিপ্লবী মেয়েটি? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হল, পাহাড়তলীতে অযতেœ থাকা একটা আবক্ষ মূর্তি ও ধলঘাটে স্মৃতি স্মারক ছাড়া আর কী-ইবা আছে, যাতে প্রীতিলতাকে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারে? তাই এবারের জন্মবার্ষিকীতে দাবি জানাচ্ছি, ঐতিহাসিক ইউরোপীয় ক্লাবটি ‘প্রীতিলতা স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হোক। দোহাজারী, চট্টগ্রাম থেকে [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App