×

মুক্তচিন্তা

রাজনৈতিক কড়চায় শফীর মৃত্যু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:২৭ পিএম

শুক্রবার তখন আমি আল্লামা আহমদ শফীর পদত্যাগ সংক্রান্ত নিউজ করার জন্য তার দীর্ঘকালীন ছাত্র, সহকর্মী, অনুসারী ও সংগঠকদের টেলিফোন নম্বর জোগাড় করে একে একে কথা বলছিলাম। দুপুর ১টার দিকে একজন বলল, ‘পদত্যাগের নিউজ করবেন, না ইন্তেকালের সংবাদ দেবেন? অবস্থা ভালো নয়, মনে হয় টিকবে না।’ সন্ধ্যায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যু সংবাদই লিখতে হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর আগে তাকে হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসার মুহতারিম পদ থেকে অপসারণের জন্য তার অনুসারীরা যা করেছেন তা মর্মান্তিক। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত ১টা পর্যন্ত প্রায় সম্বিতহীন একজন শতবর্ষী মানুষকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে নানাভাবে চাপাচাপি এবং অপদস্ত করা হচ্ছিল। বিষয়টি আমাকে অনেকেই বলেছেন। কিন্তু সময় তখন এমন, যে তারা দালাল হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়েই হোক অথবা জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীদের কাছে বিরাগভাজন হওয়ার ভয়েই হোক, মিডিয়ায় নাম প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছিলেন না। এমনই অবস্থা! আমি যে আমেরিকান মিডিয়ায় কাজ করি সেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে সংবাদ পরিবেশনের সময় কোনো বেনামি সোর্স থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই প্রতিবেদনে বিবিসির রেফারেন্স দিয়েছিলাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল্লামা শফীর পক্ষের একজন শিক্ষককে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা বলেছে, ‘শতবর্ষী আহমদ শফী খুবই অসুস্থ ছিলেন এবং তার কোনো কিছু চিন্তা করার বা বোঝার মতো পরিস্থিতি ছিল না। একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষকে বিক্ষোভের মুখে জোর করে বৈঠকে রেখে একতরফা সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ রাত ১টার পর মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির বৈঠক শেষ হলে শাহ শফীকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রশ্ন হলো, হাটহাজারীতে দেশের বৃহত্তম ওই কওমি মাদ্রাসায় ছাত্রদের স্বার্থবিরোধী নতুন কী ঘটেছে যার জন্য তারা এত বড় বিক্ষোভ গড়ে তুললেন? দেশের মাদ্রাসাগুলোতে এই ন্যাচারের ছাত্র বিক্ষোভের অতীত ইতিহাস নেই। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, যিনি তাদের ‘বড় হুজুর’ যিনি কওমি মাদ্রাসার ইতিহাসে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। যার তৎপরতায় মাত্র ১৮-১৯ বছর বয়সে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পাসের সমমান স্বীকৃতি পেয়েছেন। হাটহাজারীর ওই মাদ্রাসার জন্য রেলের জমি বরাদ্দসহ বহু বহু সুবিধা তিনি শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। তার দাবিতে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ইসলামিকরণসহ কিনা করেছেন শেখ হাসিনা! যেসব কারণে আমরা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে আদর্শচ্যুত বলে সমালোচনা করি। কিন্তু যাদের জন্য সরকার এসব করেছে, তারা কি কৃতজ্ঞ? হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসায় শফী হুজুর এবং তার পুত্র মাওলানা আনাস মাদানীকে সরানোর জন্য ছাত্ররা যে বিক্ষোভ করেছে, তা সেই মৌলিক রাজনীতির জায়গা থেকেই হয়েছে। নইলে মাদ্রাসার কর্তৃত্ব নিয়ে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে যে বিরোধ তাতে ছাত্রদের এত বিপুলভাবে যুক্ত হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংস্কৃতিতে সরকারের সঙ্গে যার সম্পর্ক ভালো, যিনি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার জন্য সুযোগ-সুবিধা এনে দিতে পারেন প্রতিষ্ঠানে তিনিই কর্তৃত্ব করেন। মাওলানা আনাস মাদানী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে অনেক সুবিধা এনে দিয়েছেন এবং এনে দিতে পারেন। উপরন্তু তিনি আল্লামা শফীর পুত্র। সব বিবেচনায় তার কর্তৃত্ব মেনে নিতে ওই মাদ্রাসায় সংশ্লিষ্টদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শাহ আহমদ শফী মনে করতেন মেয়েদের ক্লাস থ্রি-ফোরের বেশি পড়ানোর দরকার নেই। হলি আর্টিজানে বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য দেখিনি। তবে চাপাতি বাহিনীর একের পর এক হামলার সময় তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘বøগারদের হত্যা করা ওয়াজিব।’ সঙ্গত কারণেই তার এবং তার অনুসারীদের সঙ্গে চিন্তাশীল প্রগতিশীল মানুষের লড়াই অনিবার্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ শফীকেই আদর্শ মনে করেন। তাদের কাছে পেতে বিএনপি-জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি সবসময় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে। আওয়ামী লীগও তাদের হারাতে চাইবে বলে মনে হয় না। বহুমাত্রিক টানাটানিতে হেফাজত ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু তালেবানি চিন্তাধারা ম্রিয়মাণ হবে না। বৃহত্তর তালেবানি প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠাও অসম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গন্তব্য অনিশ্চিত। সাংবাদিক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App