×

জাতীয়

ভেজালপণ্যে সয়লাব বাজার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১৭ এএম

ভেজালপণ্যে সয়লাব বাজার

পণ্য

  • অভিযানেও থামছে না ভেজাল কারবার।
  • বাতিল করা পণ্য মিলে বাজারে।
  • জরিমানাতেই পার পেয়ে যায় অসাধুরা।

একের পর এক ভেজারবিরোধী অভিযান হলেও বাজার সয়লাব ভোজালপণ্যে। কসমেটিক থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য, মিষ্টি, মসলা, ভোজ্যতেল, রাইস ব্রান অয়েল, লবণ, ঘি কিসে নেই ভেজাল। বাজারে ভেজাল ছাড়া পণ্য চিহ্নিত করা বড় মুশকিল। কিসে যে ভেজাল আর কিসে নেই, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভোক্তারা। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটসহ (বিএসটিআই) বিভিন্ন সংস্থা মোবাইল কোর্ট বসালেও কার্যত ভেজাল থেমে নেই। শুধু জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায় ভেজাল উৎপাদনকারী ও বিপণনকারীরা। দেশে ভেজাল নির্মূলে কঠিন আইন থাকলেও আজো সর্বোচ্চ বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি কোনো ভেজালকারীকে। ফলে দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। এ ছাড়াও ভেজালের অভিযোগে বাতিল করা পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার কোনো ধরনের তাগাদা থাকে না। সেই সুযোগে বিএসটিআইয়ের অগোচরে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তা ম্যানেজ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে ভেজালের মচ্ছব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া লাচ্ছা সেমাই থেকে শুরু করে ভেজাল মসলা, ভেজাল কসমেটিক, ঘি, শিশুখাদ্য, ভোজ্যতেল বাজারজাত হচ্ছে। দেখতে অনেকটা বিদেশি কসমেটিকের মতো মোড়কে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত পণ্য বিদেশি বলে বিক্রি হচ্ছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা ঠকছেন; অন্যদিকে দিন দিন স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে চলেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল মিশ্রণে তৈরি করা মানহীন সেমাই, নুডলস, ঘি এবং মরিচ, হলুদ ও মসলার গুঁড়া বাজার দখল করে নিচ্ছে। এসব মানহীন খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের জন্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক। সেমাই ও নুডলস তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়া ময়দা, পামঅয়েল, অ্যারারোট, সাবান তৈরির রাসায়নিক উপাদান তাল্লু ও এক ধরনের রাসায়নিক পাউডার। মরিচের গুঁড়া তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পচা মরিচ (পটকা), ধানের তুষ, ইটের গুঁড়া ও লাল রং। তেমনিভাবে হলুদ ও মসলার গুঁড়া তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নষ্ট হয়ে যাওয়া হলুদ ও মসলা, পচা

চালের গুঁড়া ও রং। ঘি তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যধিক হারে পামঅয়েল, অতি নি¤œমানের ডালডা, বেকারি ঘি ও রাসায়নিক রং। এছাড়া পটকা, ধানের তুষ, ইটের গুঁড়া, পচা চাল, পচা মসলা ও রং ব্যবহার করে বেনামে প্যাকেট করে নি¤œমানের মরিচের গুঁড়াসহ হলুদ মসলার গুঁড়া বাজারজাত করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর চকবাজার, বাবু বাজার, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, গেন্ডারিয়া, ডেমরা, উত্তরার দক্ষিণখান, উত্তরখান, দিয়াবাড়ি এবং রাজধানীর পাশে টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার কেরানীগঞ্জ এলাকায় রয়েছে শত শত ভেজালপণ্য উৎপাদনের কারখানা। এসব কারখানায় ময়লা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজালসব খাদ্যপণ্য।

আরেকটি মজার বিষয় হলো- বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স না নিয়েও লোগো ব্যবহার করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেক সময় একই ব্রান্ডের লেভেল নকল করে বাজারে পণ্য ছাড়ছে। বিভিন্ন সময় অভিযানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। তারপরও থেমে নেই ভেজালপণ্য উৎপাদনকারী অসাধু চক্র।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসটিআর সার্টিফিকেশন এন্ড মার্কসের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক মো. সাজ্জাদুল বারী ভোরের কাগজকে বলেন, বিএসটিআই কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ করে পণ্য বাজারজাতের অনুমোদন দিয়ে থাকে। বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভেজালের বিরুদ্ধে সবসময় তৎপর বিএসটিআই। বিভিন্ন সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে বিএসটিআইর ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল রয়েছে। মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাদ্যে পাওয়া গেছে প্রায় শতভাগ ভেজাল। মিষ্টি জাতীয় খাবার মধু, রসগোল্লা, চমচম, ছানার মিষ্টি ও আচারে ভেজালের পরিমাণ সর্বাধিক। এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা, পারদ, নিকেল, অ্যালুমিনিয়াম, লিথিয়ামের মতো বিষাক্ত উপাদান। উৎপাদনের সময় দূষিত পানি, মাটি ও পোকা দমনে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য বিষাক্ত করা হচ্ছে।

সাধারণত এসব বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এর আগে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ভেজাল বিষয়ে এক প্রতিবেদন তৈরি করে। এই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঘিতে ভেজালের হার ৯৩ শতাংশ, সেমাইয়ে ৮৩ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৭৮ শতাংশ, সরিষার তেলে ৫৬ শতাংশ, বিস্কুটে ৪৬ শতাংশ, জিরায় ১৮ শতাংশ, আটায় ১১ শতাংশ, মরিচের গুঁড়ায় ৬০ শতাংশ, মসুরের ডালে ৬ শতাংশ, হলুদ গুঁড়ায় ৩১ শতাংশ, চিনিতে ৫ শতাংশ, চা পাতায় ১০ শতাংশ, পামঅয়েলে ৩২ শতাংশ, লবণে ৩৬ শতাংশ, ধনেগুঁড়ায় ৫৩ শতাংশ, খেজুরের গুড়ে ২৫ শতাংশ, মুগডালে ৯ শতাংশ, সুজিতে ২৭ শতাংশ, ব্যসনে ৫২ শতাংশ, চাটনিতে ৮৩ শতাংশ, কোকে ৭০ শতাংশ, নারিকেল তেলে ২৫ শতাংশ, মিষ্টিতে ৯৮ শতাংশ, আখের গুড়ে ৫৭ শতাংশ, ময়দায় ৯ শতাংশ, আচারে ৮৮ শতাংশ, জুসে ৯২ শতাংশ ভেজাল মেশানো হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ও ল্যাব টেস্টে ভেজালের উপস্থিতি মিলেছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বাজারে প্রচলিত সব ধরনের খাদ্যপণ্যের ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভেজাল। এর আগে বিএসটিআই ৯৬টি প্রতিষ্ঠানের দুধের মধ্যে ৯৩টিতে ক্ষতিকর উপাদান পায়। এছাড়া ৫২ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেও মেলে ভেজাল। বিএসটিআই ঘোষিত ৫২টি ভেজালপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার এবং মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ রাখার দাবিতে হাইকোর্টে রিট করে বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস)। পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ ওই ৫২টি খাদ্যপণ্য বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মার্কেটে থাকা এসব পণ্য জব্দ করে তা ধ্বংস করা ও ভেজালপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তখন থেকে সারাদেশে একযুগে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার দাবি করে আসছে এই সংগঠনটি।

এসব বিষয়ে কথা হয় সিসিএসের নির্বাহী সম্পাদক পলাশ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বাজারে প্রায় ৭৩ শতাংশ পণ্যে ভেজাল রয়েছে। এই ভেজাল বন্ধে প্রয়োজন সারাদেশে একযুগে অভিযান পরিচালনা করা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলোÑ ভেজাল প্রতিরোধে দেশে কঠোর আইন থাকলেও এর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। আজো ভেজাল প্রতিরোধে সর্বোচ্চ বিচারের মুখোমুখি হয়নি কোনো ভেজাল উৎপাদন ও বিপণনকারী। শুধু জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাওয়াতে এসব চক্র দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলেও অভিমত তার।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৩৪৩টি অভিযানের মাধ্যমে ২০ হাজার ৭০৩ প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ৪ হাজার ৭৭টি বাজার অভিযানের মাধ্যমে ১৩ হাজার ৬৫২ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অর্থাৎ ধারাবাহিক ভোজালবিরোধী অভিযান যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ভেজাল উৎপাদনকারী।

ভেজালবিরোধী অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযানে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর জিরো টলারেন্স নীতিতে চলছে। নকল ও ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া কোনো ভোক্তা ভেজালপণ্য উৎপাদন বা বিপণন হচ্ছে বলে অভিযোগ করলে তাও আমরা খতিয়ে দেখি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App