×

রাজনীতি

ব্যবসায়ী-আমলার দাপটে হতাশ ত্যাগী নেতাকর্মীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৩ এএম

অরুণ সরকার রানা। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক। দলের দুঃসময়ে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে বিরোধী দল কি সরকারি দল- যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যানার হাতে দল ও নেত্রীর পক্ষে দাঁড়াতে দেখা গেছে তাকে। ৪০ বছর চলার পর হঠাৎ তার কণ্ঠে রাজনীতি থেকে অবসরের সুর। সম্প্রতি নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেন ‘রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে চাই’। দলের সুসময়ে হঠাৎ কেন তার এ ঘোষণা?

জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ক্ষোভ বা অভিমান থেকে নয়। ৪০ বছরের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু কন্যার স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। এখন দলের সুসময়। আন্দোলন-সংগ্রাম নেই। তাই একটু অবসর নিতে চাই। ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজনীতিতে আসার ফলে এ সিদ্ধান্ত কিনা- জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতিতে ব্যবসায়ী প্রয়োজন আছে। সে জন্য এ সিদ্ধান্ত নয়।

ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসা মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, মেয়র এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেই। দলটির তৃণমূলের কারো কারো মতে, চলমান রাজনৈতিক ধারায় ব্যবসায়ীদের আসা বড় কোনো ক্ষতি নয়; বরং দলের জন্য ভালো। কারো কারো মতে, ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের মূল কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া কখনোই সহজ ছিল না। যা এখন ব্যবসায়ীদের জন্য অতি সহজ। হঠাৎ ব্যবসায়ীদের দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ায় ত্যাগীদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। পাল্টে যাওয়া এই আওয়ামী লীগকে নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।

উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার সরকার দলীয় সাবেক এক সাংসদ বলেন, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও বহু চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে দলকে ক্ষমতায় এনেছেন। সফলতার সঙ্গে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন। তার প্রতি তৃণমূলের আস্থা আছে। তবে তৃণমূলে হতাশাও আছে। যা দলীয় প্রধানের কাছে হয়তো সঠিকভাবে পৌঁছায় না। কারণ রাজনীতিতে এখন সুবিধাভোগী, চাটুকার-হাইব্রিডদের ভিড়। তার ওপর আমলাতন্ত্রের প্রভাব। প্রকৃত রাজনীতিকরা তাদের কাছে অনেকটা কোণঠাসা। অভিমানে অনেকেই রাজনীতি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। শুধু কেন্দ্রে নয়, তৃণমূলের রাজনীতিও এখন অনেকটা ব্যবসায়ী বা টাকা ওয়ালাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও আমলাদের জয়জয়কার।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশীদের মতে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগে বহু অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কখনোই বিশ্বাস করে না। গণভিত্তিসম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলে এটা প্রত্যাশিত নয়। তবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যদি এ দলের নেতৃত্বে না থাকতেন, তাহলে হয়তো আরো নেতিবাচক পরিবর্তন আমরা দেখতে পেতাম। তিনি বলেন, এ কথা ঠিক আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে অধিকতর আমলাতন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়েছে। এটা একটা বড় পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ যেমন আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর হতে পারে না। তেমনি কোনো সন্ত্রাসী বা পেশি শক্তির ওপরও নির্ভর হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাই ছিল জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সবসময় রাজনৈতিক পথ চলা এবং প্রশাসন পরিচালনা করা।

সম্প্রতি ব্যবসায়ী নেতা সিদ্দিকুর রহমান আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের পদ পাওয়ায় কারো কারো প্রশ্ন ব্যবসায়ীরা কি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও দখল করছেন? সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হাসানুজ্জামান তারেকের একটি ফেসবুক পোস্টে ছিল, ‘দল ক্ষমতায় এক যুগ। আদর্শিক কর্মীর সংখ্যা কত বেড়েছে, তা জানা না গেলেও আন্দোলন-সংগ্রামে নিবেদিত কয়েক লাখ কর্মী ভেসে গেছে (নিখোঁজ) ভরা জোয়ারের উত্তাল তরঙ্গে’। একজন সাংবাদিকের একটি লেখা শেয়ার করে তিনি আরো লিখেন, ‘ছাত্র ও যুব রাজনীতির কী দরকার? সহযোগী সংগঠনের মতো বিজিএমইএ সেরা। শুধু মনোনায়ন নয় দলের কেন্দ্রীয় পদও মেলে। শুভ কামনা বিজিএমইএ... ক্ষমতার রাজনীতিতে আপনাদের কাছে আওয়ামী লীগের খারাপ সময়ের কর্মীদের শেখার আছে। আগে একজন কর্মী নেতা হতো মানুষের সঙ্গে মিশে, এই কারণে কোনো পদবি পাওয়ার আগেই মানুষ তাকে চিনত।

তবে দলটির সিনিয়র নেতাদের মত হচ্ছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কিছু কিছু টেকনিক্যাল পদে ব্যবসায়ী, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা, আমলা, সাংবাদিকদের রাখা হয়। যেমন শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক টেকনিক্যাল পদ। রাজনীতিকের থেকে একজন ব্যবসায়ী এটা ভালো বুঝেন। আবার নিজের দলের রাজনীতি যেন ধ্বংস না হয়, সে কারণে দলের অ্যাকটিভ পদ যেমন সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রাজনীতিকরাই আসছেন, টাকাওয়ালারা নয়।

দলটির বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন, ঐতিহ্যগত রাজনীতিবিদ ছাড়াও ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রত্যেকটা শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট একটা শ্রেণি দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি কখনোই সম্ভব নয়। বিএনপি-জাতীয় পার্টির থেকে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে ছিল। ‘৯১ এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা শুরু করে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে সবাইকে সন্তুষ্ট রেখেই রাষ্ট্র চালাতে হয়। দেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ ও অর্থনীতি সচল রাখতে ব্যবসায়ীরা ভ‚মিকা রাখেন। প্রধানমন্ত্রীও চান ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা থাকুক। তার মতে, আওয়ামী লীগ তার কর্ম ও স্বকীয়তায় এখন জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হয়েছে। সরকার বা বিরোধী দল যেখানেই এই দল অবস্থান করুক, রাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে চলবে না। এটি বাস্তবতা। নীতিনির্ধারণ, উন্নয়ন, সংহতি, জাতীয় নিরাপত্তা সবক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে আসছে। এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে সমাজের সব শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষের অংশ নেয়া এবং মত প্রকাশের সুযোগ থাকতে হবে। এ কারণেই ইতিবাচক ব্যবসায়ী, জনমুখী আমলাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এটি ইতিবাচক।

এ পর্যন্ত ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন ঢাকা-১ আসনের সাংসদ এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা তিনি। কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি টিপু মুনশি আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা টিপু রংপুর-৪ আসন থেকে পরপর ৩ বার সাংসদ নির্বাচিত হন। বর্তমান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তিনি। শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ছিলেন বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। গত মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সাংসদ হন ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা। বিজিএমইএর আরেক নেতা এস এম মান্না কচি ঢাকা মহানর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ছিলেন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগেরও সভাপতি। বিজিএমইএর আরেক সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। খুলনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। আতিকুল ইসলাম ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র। এর আগে এই সংস্থাটির মেয়র ছিলেন এফবিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি প্রয়াত আনিসুল হক। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত রয়েছেন এরকম আরো অনেক ব্যবসায়ী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন অর রশীদ এর মতে, পরিবর্তন শুধু আওয়ামী লীগেই নয়। পরিবর্তন সমাজ তথা সারাবিশ্বেই হচ্ছে। একটা দল, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র একই জায়গায় কখনো স্থিতিশীল থাকে না। পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। বাংলাদেশ ও বিশ^জনিন পরিবর্তিত অর্থ ব্যবস্থার নিরিখে দলকেও খাপ খাইয়ে চলতে হয়।

তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল যেখান থেকে যাত্রা শুরু করে, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কেননা সমাজ পরিবর্তন হয়, মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয়। সমাজের অভ্যন্তরে নতুন নতুন সম্ভাবনা ও তাগিদ দেখা দেয়। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটা দলকে চলতে হয়। কোনো দল যদি শুরুর অবস্থানেই স্থির থাকে, সেই দলের আর বিকাশ হয় না। দলটি টিকেও না। সেক্ষত্রে আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ দিক হলো পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে দলটি সবসময় খাপ খাইয়ে চলে। এটা ঠিক শেখ হাসিনা নেতৃত্ব আছে বলেই আওয়ামী লীগ তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। গরিব, সাধারণ মানুষ ও দেশের জনগণের স্বার্থের পক্ষেই দলটির দৃষ্টি এবং পলিসি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App