×

মুক্তচিন্তা

টিউশন ফি কমানো এবং শিক্ষকদের সম্মানী দুটিই জরুরি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৩২ পিএম

করোনা ভাইরাস আমাদের নানামুখী পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে। করোনা ভাইরাসের হাত থেকে জীবন বাঁচানোর নিত্য যুদ্ধের পাশাপাশি জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানের সংগ্রামও সমানতালে চলছে সর্বত্র দেশে এবং বিদেশে। গত মার্চ থেকে জুলাই/আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে সরকারি, আধা-সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কিছু নির্দিষ্ট চাকরিজীবী ছাড়া যাদের চাকরি স্থায়ী, সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষ জীবিকার সংকটের মধ্য দিয়ে দিনতিপাত করেছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, কুলি, বস্তিবাসী, গৃহকর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, যৌনকর্মী, দিনমজুর, কামলা, রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, বেসরকারি চাকুরে, হকার, সাংবাদিক, উকিল-মোক্তার, শিক্ষক, টিউশনিকারী, ড্রাইভার-হেলপার, নি¤œ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং কিছু কিছু উচ্চ-মধ্যবিত্তও জীবন-জীবিকার একটা ছোটখাটো যুদ্ধের ভেতর দিয়ে দিন গুজার করেছে। এ রকম একটা অভাবনীয়, অভ‚তপূর্ব এবং অপ্রত্যাশিত কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে গোটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় দিন পার করছিল তখন বাংলাদেশের শহুরে, শিক্ষিত ও নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে সন্তান-সন্ততিদের পড়াশোনাও একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা অশেষ শুকরিয়ার বিষয় যে, বিশ্বব্যাপী যখন লাখে লাখে লোক সংক্রমিত হচ্ছিল এবং হাজারে হাজারে মানুষ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মারা যাচ্ছিল, তখনো বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যা ৩-৪ হাজারের বেশি হয়নি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ৪০-৫০-এর ঘর অতিক্রম করেনি। কিন্তু এ রকম একটি অবস্থায়ও সন্তান-সন্ততিদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় পড়াশোনার ব্যাপারে মানুষ খানিকটা উদ্বিগ্ন ছিল। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভাগীয় শহর এবং বেশিরভাগ জেলা শহরের অভিভাবক সন্তান-সন্ততিদের পড়াশোনা দিয়ে যখন উদ্বিগ্ন, তখনই অনলাইন ক্লাসের ধারণা সামনে চলে আসে। বিশেষ করে শহরের স্কুলগুলো অনলাইনে ভার্চুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহারে ক্লাস করতে পারবে। এতে করে অভিভাবকরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। স্কুলগুলোও নিজেদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে এ বিবেচনায় খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন বা টিউশন ফি নিয়ে। এবং এ সমস্যা ক্রমান্বয়ে এমন এক অবস্থায় এসে হাজির হয় যে, অভিভাবকরা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাসিক টিউশন ফি কমানোর দাবিতে মানববন্ধন করতে বাধ্য হয়, যা বাংলাদেশে প্রায় সব সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচারিত হয়। বিভিন্ন প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলও স্কুলের মাসিক টিউশন ফি কমানো নিয়ে স্পেশাল রিপোর্ট তৈরি করে। ফলে করোনা ভাইরাসের আলোচনায় স্কুলের টিউশন ফি কমানোর ইস্যুটিও মিডিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বাকারে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা কার্যক্রমের কথা বাদ দিলে (কারণ ইংরেজি মাধ্যমে নিয়মিত অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে এবং শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের একটা বড় অংশ আর্থিকভাবে সচ্ছল!) বাংলাদেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমের বাংলা এবং ইংরেজি ভার্সনের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে বাংলাদেশের বিভাগীয় শহর ছাড়াও প্রায় সব জেলা শহরের স্কুলে এপ্রিল মাস থেকেই অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। কিন্তু অভিভাবকদের পক্ষ থেকে মাসিক টিউশন ফি কমানোর সপক্ষে প্রধানত তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে : এক. অনলাইন ক্লাস আর নিয়মিত ক্লাস এক নয়। ক্লাসের গুণগত মান রেগুলার ক্লাসের চেয়ে অনেক কম। সুতরাং রেগুলার ক্লাসের জন্য টিউশন ফি মাসিক ৩০০০ বা ২০০০ টাকা হলে অনলাইন ক্লাসের টিউশন ফি যথাক্রমে ২০০০ বা ১২০০ টাকা হওয়া উচিত। বা একটা গ্রহণযোগ্য এবং বিচার-বিবেচনাযোগ্য ডিসকাউন্ট থাকা উচিত। দুই. করোনা ভাইরাসের কারণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে আর্থিক ক্ষতি বা সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সন্তান-সন্ততিদের স্কুলের টিউশন ফি বাবদ মাসিক ৩০০০/২০০০ টাকা দেয়া সংসারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করছে। তাই টিউশন ফি একটা যৌক্তিক হারে কমানো উচিত। তিন. অনলাইনে ভার্চুয়াল ক্লাস করতে গিয়ে অনেক অভিভাবককে মোবাইল ডাটা কিনতে হয় এবং অনেক অভিভাবকের বাড়তি টাকা বিনিয়োগ করে ওয়াইফাইয়ের স্পিড বাড়তে হয়েছে। ফলে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমে অনলাইনের জন্য আলাদা কোনো ফি দিতে হয় না, কিন্তু ভার্চুয়াল ক্লাসের জন্য অভিভাবককে বাড়তি টাকা গুনতে হয় বলে স্কুলের মাসিক টিউশন ফি কমানো উচিত। আর টিউশন ফি না কমানোর পক্ষে স্কুলগুলো প্রধানত তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করছে : এক. পুরোপুরি সরকারি স্কুলগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের বিভাগীয় এবং জেলা শহরের বেশিরভাগে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় মূলত ভাড়া করা বাসায় স্কুল পরিচালনা করছে। ফলে করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বাসা ভাড়া তো আর বন্ধ নেই। স্কুলগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়মিতভাবে অনলাইন ক্লাস চালু করে এবং সেটা নিয়মিতকরণের মধ্য দিয়ে স্কুলগুলো প্রধানত টিকে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত। কারণ ভাড়াটিয়া তো ৫-৬ মাসের জন্য বাসা ভাড়া মওকুফ করবেন না। সুতরাং টিউশন ফি কমালে মোটা অঙ্কের টাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে স্কুল চালানো এবং স্কুলগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। দুই. স্কুলের শিক্ষকরাও নানাভাবে করোনা ভাইরাসের কারণে নানা ধরনের আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষকরাও টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। তাই যদি টিউশন ফি কমিয়ে দেয়া হয়ে, তাহলে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন যথাযথভাবে দেয়া সম্ভব হবে না। ফলে টিউশন ফি কমানো সম্ভব নয়। তিন. যখন স্কুল খোলা থাকে তখন নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের স্কুল যাতায়াতের একটা খরচ বহন করতে হয়। কিন্তু অনলাইন ক্লাস হওয়ার কারণে শিক্ষকরা ভার্চুয়ার ক্লাস নেন বিধায় শিক্ষার্থীদের আর স্কুলে যেতে হয় না। ফলে অভিভাবকদের যাতায়াত বাবদ খরচ হওয়া একটা বড় অঙ্কের টাকা বেঁচে যায়। তাই স্কুলের পাশাপাশি এবং শিক্ষকদের বাঁচানোর স্বার্থে নিয়মিত হারে টিউশন ফি’টা দেয়া উচিত। উভয়পক্ষের যুক্তিই একেবারে বিনাবাক্যে পরিত্যাগ করা যাবে না, কেননা উভয়পক্ষের যুক্তির মধ্যে সত্যতা আছে, বাস্তবতা আছে এবং বিবেচনার বিষয় আছে। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্কুল পরিচালক/কর্মকর্তা/প্রিন্সিপাল সবাই পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। শিক্ষকরা শিক্ষা দেবেন শিক্ষার্থীদের। তাই অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষক এবং স্কুলকে টিকিয়ে থাকতে সাহায্য করা। কেননা স্কুল এবং শিক্ষক টিকে থাকলে শেষ বিচারে অভিভাবকদেরই লাভ কেননা তাদের সন্তান-সন্ততি শিক্ষিত হবে। আবার বিপদের দিনে অভিভাবকদের দিকেও তাকাতে হবে কেননা অভিভাবকরা টিকে থাকলেই তাদের সন্তান-সন্ততিদের স্কুলে পাঠাতে সক্ষম হবে, যার মধ্য দিয়ে টিকে থাকবে স্কুল এবং শিক্ষক। করোনা ভাইরাস একদিকে আমাদের যেমন শঙ্কিত এবং আতঙ্কিত করেছে, তেমনি অন্যদিকে আমাদের করে তুলেছে সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল। তাই টিউশন ফি যৌক্তিক হারে কমানোর মাধ্যমে আমরা যেমন বিপদগ্রস্ত অভিভাবকদের পাশে দাঁড়াতে পারি, আবার এ করোনার সংকটকালে স্কুল ও শিক্ষকদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে আমাদের সন্তান-সন্ততিদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য স্কুলগুলো টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা করতে পারি। তবে আশার সংবাদ এই যে, ইতোমধ্যে বেশকিছু স্কুল ২০-২৫ শতাংশ টিউশন ফি কমিয়েছে, যাতে অভিভাবকদের খানিকটা হেল্প হয়, যা দিয়ে নিদেনপক্ষে মোবাইল ডাটা বা ওয়াইফাইয়ের বিল দেয়া সম্ভব হয়। যেসব স্কুল একটা গ্রহণযোগ্য এবং বিবেচনাযোগ্য ডিসকাউন্ট দিয়ে টিউশন ফি কমিয়েছে, আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। আবার সচ্ছল অভিভাবকরা এ মহামারিকালে স্কুল ও শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াবেন, সেটাও কাক্সিক্ষত। মনে রাখতে হবে, টিউশন ফি কমানো এবং শিক্ষকদের সম্মানী দুটিই জরুরি এবং সমান গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App