×

সারাদেশ

কুয়াকাটায় পর্যটন ঘিরে বাড়ছে অপরাধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৮ পিএম

কুয়াকাটায় পর্যটন ঘিরে বাড়ছে অপরাধ

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত (ফাইল ছবি)

পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় আবাসিক হোটেলে একের পর ঘটছে হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, যৌনতা, মাদক ও চোরা চালানীদের পাচার বানিজ্য। দেহ ব্যবসা ও মাদক ব্যবসার অন্তরালে পর্যটক কেন্দ্রীক নানান অপরাধ প্রবনতা ক্রমশই বেড়েই চলছে বঙ্গোপসাগরের তীরঘেষা এই পর্যটন শহরে। নামী-বেনামী কিছু আবাসিক হোটেল মালিকদের অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বদনামের ভাগিদার হচ্ছেন ভাল মানের আবাসিক হোটেল ও ট্যুরিজম ব্যবসায়ীরা। ওইসব বেনামী আবাসিক হোটেলগুলো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে গোস্ট রেজিস্ট্রারে নামভুক্তি না করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোরও টিনেজদের কাছে হোটেল মোটেল কক্ষ ভাড়া দেওয়ার কারণেও অনেক সময় ঘটছে নানা অপ্রতিকর ঘটনা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রচার মাধ্যমে কুয়াকাটার নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ছে দেশী বিদেশী পর্যটকদের মাঝে। কুয়াকাটা পর্যটন শিল্পের ওপর নেতীবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের মাঝে। এ নিয়ে কুয়াকাটা আবাসিক হোটেল মালিক ও স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। বৈধভাবে ব্যবসা করে আসা আবাসিক হোটেল মালিকরা প্রশাসনের কাছে অসামাজিক ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাধিবার অনুরোধ জানালেও প্রতিকার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আবাসিক হোটেল আল্লার দান থেকে এক জেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই জেলের কক্ষ থেকে যৌন উত্তেজক জাতীয় ট্যাবলেটের খোসা ও কনডম আলামত হিসেবে জব্দ করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে রাতে ঐ হোটেলে পতিতা সরবরাহ করা হয় বোর্ডারদের কাছে। ওইদিনই সন্ধায় আবাসিক হোটেল সাউথ বাংলা থেকে খুলনার সৌরভ জামিল সোহাগ (৫৫) নামে এক পর্যটকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেড়িয়ে আসে বন্ধু টুকু বালিশ চাপা দিয়ে সোহাগকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। একের পর এক এমন হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে আবাসিক হোটেল গুলোতে।

কুয়াকাটাকে অপরাধীরা অপরাধের নিরাপদ জোন হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে সচেতন মহলের অভিমত। যার ফলে ক্রমশই বাড়ছে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এছাড়াও দেহব্যবসা, মাদক বানিজ্য,বন্যপ্রাণী পাচারকারীর সদস্যরা প্রায়ই আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে আটক হয়। দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক চোরা কারবারীরা পর্যটকের আড়ালে এসব নানা অপরাধমুলক কাজ করে সহজেই সটকে পড়ছে। অপরদিকে বঙ্গোপসাগরকে নৌ-রুট হিসেবে ব্যবহার করে ভারতও মিয়ানমার থেকে শাড়ি,কাপড় ও মাদকের বড় বড় চালান নিয়ে আসে চোরাচালানী সিন্ডিকেট চক্র। মাঝে মধ্যে দুই একটি চালান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হলেও বেশীর ভাগ থেকে যায় অধরায়।

ইয়াবা ও কাপড়ের বড় বড় কয়েকটি চালান আটক হলেও এর সাথে জড়িত মুল হোতারা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এসব চোরা কারবারীরা মাদক ও পন্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রে সমুদ্রে মাছধরারত জেলেদের ট্রলার ও মাছ বিপননের পরিবহনকে ব্যবহার করার নজির রয়েছে একাধিক। মহিপুর ও কলাপাড়া থানায় ইয়াবার চালান ও ভারতীয় পন্য আটকের বিষয়ে একাধিক মামলাও রয়েছে।

নিম্নমধ্যম শ্রেনীর আবাসিক হোটেলগুলোতে নিয়ম কানুন না মেনে পর্যটক রাখার কারণে অপরাধীরা অপরাধ সংগঠিত করে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে । প্রতিনিয়ত কুয়াকাটা আবাসিক হোটেলসহ মহিপুর থানা এলাকার ভৌগলিক সীমানার মধ্যে নানা অপরাধ সংগঠিত হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর আবাসিক হোটেল আল মদিনায় ঢাকার আশুলিয়ার কান্তা বিউটি পার্লারের মালিক মার্জিয়া আকতার কান্তাকে স্বামী ও দেবর হত্যা করে পালিয়ে যায়। হোটেলের মালিক কান্তার লাশ সাগরে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় কান্তার বাবা ২০১৯ সালের ফ্রেরুয়ারিতে নরসিংদীতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এঘটনায় স্বামী দেবর ও হোটেলের দুই মালিককে নরসিংদী পিবিআই গ্রেপ্তার করে।

সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) কান্তার স্বামী সাগরকে নিয়ে পিবিআই কুয়াকাটা ঘটনাস্থলে দ্বিতীয়বার তদন্তে আসে। চলতি বছর ১৭ আগষ্ট আবাসিক হোটেল সাগরের কক্ষে রাঙ্গাবালীর মাদ্রাসা ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগে ১৩ সেপ্টেম্বর ওই ধর্ষিতার বাবা বাদী হয়ে রাঙ্গাবালী থানায় অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করে। গত ২৪ আগষ্ট একই হোটেল কক্ষে পটুয়াখালীর লাউকাঠি ইউনিয়নের মিঠাখালী গ্রামের এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামাতো ভাইসহ দুই যুবকের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা হয়।

এছাড়াও বিশ্বাস সী প্যালেসে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর লিঙ্গ কর্তনের মত ঘটনা ঘটেছে। আবাসিক হোটেল রাজু ও সাগর নীড় হোটেলে আমতলীর স্কুল ছাত্রী গণধর্ষণের ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা ২৫ আগস্ট আমতলী থানায় অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করে। ৪ সেপ্টেম্বর আবাসিক হোটেল পাচঁতারা থেকে সরীসৃপ জাতীয় বন্য প্রাণী তক্ষকসহ এক পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৯ সেপ্টেম্বর আবাসিক হোটেল ঝিনুক ডাকবাংলো থেকে পতিতা,খদ্দের ও হোটেল ম্যানেজারসহ পাচঁজনকে আটক করে পুলিশ। আটককৃতদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মহিপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। হলিডে ইন হোটেলে গেীরনদীর সংখ্যালঘু এক মেয়েকে বিয়ের প্রলোভনে হোটেল কক্ষে হত্যা করে পালিয়ে যায় নির্মাণ শ্রমিক প্রেমিক।

পায়রা আবাসিক হোটেলে বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে এসে অতিরিক্ত মাদক সেবনে খুলনার এক যুবকের মুত্যু হয়। সান ফ্লাওয়ার হোটেলে সাতক্ষীরা শ্যামনগর এলাকার পর্যটক মোবারক হোসেন (৪৫) সৈকতের লেম্বুর বনের জঙ্গলে আত্মহত্যা করে। এর আগেও লেম্বুর বনে নাম পরিচয়হীন এক পর্যটকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সিকদার রিসোর্ট এন্ড ভিলাস এর ছয় তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে চীনা নাগরিকের মৃত্যু হয়। কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি বন থেকে এক কলেজ ছাত্রীর লাশ এবং গঙ্গামতির চর থেকে গর্ভবতী এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

সর্বশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে যমুনা হোটেল থেকে দুই পতিতা ও ৪ খদ্দেরকে আটক করে পুলিশ। যমুনা হোটেলের ভাড়াটিয়া মালিক সাইফুল ও জাহিদকে এর আগে ধর্ষণ ও পতিতা ব্যবসার অভিযোগে কয়েকবার আটক করে পুলিশ। অন্যদিকে সমুদ্রে ট্রলার যোগে আসা ইয়াবার বিশাল দু’টি চালান মহিপুর থেকে র‌্যাব-৮ আটক করে। কোষ্টগার্ডের অভিযানে ভারতীয় শাড়ি ও পন্য সামগ্রীও আটক করা হয়। যার একটি চালান এখনও মহিপুর থানায় জব্দ তালিকায় রয়েছে। যা নিলামে বিক্রির প্রক্রিয়াধীণ রয়েছে। এছাড়াও পুলিশের হাতেও একাধিকবার ইয়াবার ছোট বড় চালান ধরা পরেছে।

এধরনের অপরাধে দুই একটি ঘটনায় পুলিশ কিছু সংখ্যক অপরাধীদের আটক করতে সক্ষম হলেও অপরাধের সাথে জড়িত মুল হোতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। নিম্নমধ্য মানের আবাসিক হোটেল গুলোতে দেহ ব্যবসা, মাদক পাচার, হত্যা গুমসহ নানা অপরাধ হলেও পুলিশের তদারকির অভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। হোটেল রুমে পর্যটক রাখার ক্ষেত্রে জেলা পুলিশের দেয়া নির্দেশনা মানছে না বেশিরভাগ আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষ।

কুয়াকাটায় প্রায় শতাধিকেরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এতোগুলো আবাসিক হোটেলের মধ্যে মাত্র ১৫-২০টি আবাসিক হোটেলের লাইসেন্স রয়েছে। বাকি আবাসিক হোটেল গুলো চলছে লাইসেন্স বিহীন। ইতোমধ্যে হোটেল নিবন্ধনের জন্য জেলা প্রশাসক থেকে ওইসব হোটেল মালিকদের চিঠি দেয়া হয়েছে । অন্যথায় এসব হোটেল মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।

সৈকতে ভাসমান পতিতাদের আনাগোনা বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন ফটো গ্রাফাররা। আর্থিকভাবে লাভবান হতে অনেক হোটেলের বয় ম্যানেজার কর্তৃপক্ষের লোক চক্ষুর আড়ালে গোপণে অসামাজিক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। পুলিশ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে এদেরকে আটক করলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেড়িয়ে এসে আবার জড়িয়ে পড়ছে অসামাজিক কাজের সাথে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে এদের সখ্যতা রয়েছে। যার ফলে এরা নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত করতে সাহস ও উৎসাহ পাচ্ছে।

এ বিষয়ে কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, নিয়মকানুন মেনে তারা আবাসিক হোটেল পরিচালনা করছেন। তাদের সংগঠনের আওতাভূক্ত কোন হোটেলই অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত নয় বলে তিনি দাবী করেন। তিনি আরও বলেন সংগঠনের আওতাভূক্ত নয় এমন কিছু আবাসিক হোটেলের বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার কথা তারা শুনেছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন তিনি।

এ ব্যাপারে মহিপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কয়েকটি হোটেলের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। যে সকল আবাসিক হোটেল অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত রয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে পুলিশ । ইতোমধ্যে হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সাথে কাউন্সিল করে এবিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে বলে ওসি জানান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App