×

সারাদেশ

সাদিকের পা বাঁধা ১০ বছর ধরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৮ পিএম

সাদিকের পা বাঁধা ১০ বছর ধরে

এভাবেই সাদিককে মোটা কাপড় দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়।

সাদিকের পা বাঁধা ১০ বছর ধরে

হাতে আঘাত পাওয়ায় সাদিককে আদর করছে দাদি রহিমা বেওয়া।

গাইবান্ধার ফুলছড়িতে ১০ বছর ধরে মোটা কাপড় দিয়ে এক পা বেঁধে রাখা হয়েছে বাবা-মা হারা মানসিক প্রতিবন্ধী সাদিক হোসেনকে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না তার দাদি। অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে ছেলেটির চিকিৎসার জন্য সহায়তা চেয়েছে হতদরিদ্র পরিবার ও এলাকাবাসী।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে একটি বাঁশের সঙ্গে কাপড় দিয়ে এক পা বেঁধে রাখা হয়েছে সাদিক হোসেনের। তার বয়স ১১ বছর। মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে বলে জানান পরিবার। অবলা চোখে তাকিয়ে থাকা, কখনো নিজ হাঁটুতে কামড় দেয়া, আবার কখনো চিত হয়ে শুয়ে পড়াসহ নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গিমায় দিন কাটে কিশোর সাদিকের।

ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের পূর্ব কাতলামারী গ্রামের আইয়ুব হোসেন ও ছকিনা বেগম দম্পত্তির ঘরে দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম হয় সাদিকের। দাদি রহিমার ভাষ্য মতে, জন্মের পর ১ বছর পর্যন্ত ভালো ছিল সাদিক। টিটিনার্স ইনজেকশন দেয়ার পর থেকে হঠাৎ করে খিঁচুনি উঠে এ রকম পরিস্থিতির শিকার হয় সে। সুযোগ পেলে বাড়ি থেকে দৌড়ে চলে যায় অনেক দূরে। অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পায়ে মোটা কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয় একটি কুঁড়েঘরে কখনো বাড়ির উঠানে। এ অবস্থায় মানবেতর জীবন পার করছে বাবা-মা হারা প্রতিবন্ধী ছেলেটি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাদিকের বাবা আইয়ুব হোসেন কাজ করতেন একটি এনজিওতে। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায়-সম্বল শেষ করে সর্বশান্ত। অর্থাভাবে ছেলের চিকিৎসা করাতে না পেরে চিন্তা আর টেনশনে ৭ বছর আগে হার্ডএট্যাকে মারা যান। মারা যাওয়ার এক বছর পর সাদিকের মা ছকিনা বেগম এক মেয়ে মিষ্টি বেগম ও ছেলে সাদিককে ফেলে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার করছে। তারপর থেকে দাদি রহিমা বেওয়ার কাছে আশ্রয় হয় সাদিকের। আর মেয়েটির বিয়ে দেয়া হয়।

[caption id="attachment_243114" align="aligncenter" width="700"] হাতে আঘাত পাওয়ায় সাদিককে আদর করছে দাদি রহিমা বেওয়া।[/caption]

প্রতিবেশী রুহুল আমীন ও নাজনীন আক্তার বলেন, তারা অনেক গরীব। অনেক কষ্টে আছে। সরকার যদি তাদের একটু সহায়তা করত অনেক ভালো লাগত। তার বাবা মারা গেছে। মা অন্যকে বিয়ে করে সংসার বেঁধেছে। সাদিককে নিয়ে অনেক কষ্ট করছে তার দাদি। দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। অর্থের অভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারছে না।

সহপাঠী সাহিদ বলেন, আমরা গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলি, কিন্ত সাদিক খেলতে পারে না, আমাদের খুব খারাপ লাগে। ও যদি ভালো থাকত আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারত। সাদিককে বেঁধে রাখায় আমাদের খারাপ লাগে। ওর চিকিৎসার যদি কেউ দায়িত্ব নিতো, তাহলে হয়তো সাদিক ভালো হয়ে আমাদের সঙ্গে খেলতে পারত।

ছেলেটির দাদি রহিমা বেওয়া বলেন, ‘নাতনিকে বেঁধে রাখতে আমারও কী কম কষ্ট হয়! কিন্তু উপায় কী, বলুন!’’ মাতলামি করে, হাত দিয়ে খেতে পারে না, কথা বলতে পারে না, ফির ঘুম পারে না। ওর হচিলো টিটিনার্স ইনজেকশন দিচে, ওই তাতে থিকি ওর খুঁচনি উঠে। বাবা মারা যাবার পর থেকেই দঁড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য আব্দুর সবুর সরকার বলেন, ছেড়ে দিলে মানুষের ক্ষতি করে। ময়লা আর্বজনা খায়, তাই ভয়ে ওকে ছেড়ে দেয় না। কখন কার ক্ষতি করে বসে। টাকার অভাবে সাদিকের চিকিৎসা করাতে পারছে না ওর দাদি। দেশের বিত্তশালী ব্যাক্তিরা সাদিকের চিকিৎসার ব্যয়-ভার বহনে যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। তাহলে হয়তো সে ভালো হয়ে যেত।

উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল আলম সরকার বলেন, ছেলের চিকিৎসার জন্য জমি-জমা সব বিক্রি করি সর্বশান্ত হয়। পরে দুচিন্তায় সাদিকের বাবা মারা যায়। তার পর আর কোন চিকিৎসা হয়নি। তার দাদি লালন-পালন করছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে রহিমা বেওয়াকে বয়স্ক ভাতার কার্ড ও সাদিককে প্রতিবন্ধী ভাতার একটি কার্ড করে দেয়া হয়েছে। সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এ পরিবারের সেবায় এগিয়ে আসলে বদলে যাবে তাদের জীবন।

এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: এমদাদুল হক প্রামনিক বলেন, সাদিকের বিষয়ে আমরা অবগত আছি। সাদিককে আমরা প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়েছি, তার দাদিকেও বয়স্কভাতা দিয়েছি। এছাড়া সাদিকের চিকিৎসার বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করতে পারবো। এ ব্যাপারে তারা যদি আমাদের কাছে সহযোগিতা চায় আমরা সহযোগিতা করবো। আর পুর্নবাসনের বিষয়টি চট্রগ্রামে আমাদের মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু কেন্দ্র আছে, আমরা সেখানেও তার পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে পারবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App