×

মুক্তচিন্তা

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:৩৭ পিএম

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী চলে গেলেন। একে একে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকরা চলে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টটি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মৃত্যু সংবাদ শুনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সৃজনশীল লোকরা অবশ্যই বলবেন, জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মৃত্যু প্রগতির জন্য বিরাট ক্ষতির ব্যাপার হয়ে গেল। প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার ধারক-বাহক জিয়াউদ্দিন তারিক আলী আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য রেখে গেছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরা সত্য-সুন্দরের চেতনার জ্বলন্ত মশাল। যে মশালের প্রজ¦লিত আলোক শিখার পবিত্রতাকে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার বাহকদেরই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আলোর পথের যাত্রীরা মনে করেন তার চলে যাওয়ায় সুন্দরের পথের যাত্রীবাহী গাড়িটাকে যেন মাঝে পথে কেউ থামিয়ে দিতে না পারে, সে ব্যাপারে তার ভাব-শিষ্যদেরই সজাগ থাকতে হবে। কেননা আজকাল দেখা যায় অশুভ শক্তির ধারক-বাহকরা আমাদের প্রগতির মশালকে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বিশেষভাবে তৎপর হয়ে আছে। অশুভ শক্তির ধারক-বাহকরা আজ ঘরে-বাইরে, এমনকি আপন দলের মধ্যেও লুকিয়ে থেকে আমাদের চরম ক্ষতি করে যাচ্ছে। জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর গুণগ্রাহীরা মনে করেন তার আরো অনেক বছর বাঁচার প্রয়োজন ছিল প্রগতির লড়াইয়ের স্বার্থে।

যারা রাজনৈতিক সচেতন তারা সবাই জানে জিয়াউদ্দিন তারিক আলী গণমানুষের লোক ছিলেন। যেখানেই মানুষের ওপর অন্যায় হয়েছে, সেখানেই তিনি স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন। নিজে যেমন অন্যায় করেননি, ঠিক তেমনিভাবে অন্যায়কে কখনো আশ্রয়-প্রশ্রয় দেননি। এমন একজন সৎ মনোভাবাপন্ন সাদা মনের মানুষ যখন না ফেরার দেশে চলে যান, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে আগামী দিনের চিন্তায় মন-প্রাণ-অন্তর ভয়ার্ত হয়ে ওঠে। এমন প্রকৃতির মানুষ সামাজিক জীবনে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মনের গভীর গোপনে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষ প্রকৃত অর্থেই জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মতো মানুষকে বন্ধুর মতো দেখে থাকে এবং আপন দলের লোক মনে করে সারা জীবন ভালোবেসে যায়।

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে আপন সন্তানের মতো গড়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম। তিনি দেশের অসহায় অধিকারহীন মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন ঠিক ততটাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের।

সংগীত-পাগল মানুষ মাত্রই জানেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী গান-পাগল মানুষ ছিলেন। সুরের দোলায় দোলে তিনি মানুষের মনের কথাগুলো সংগীতের সুরেলা সুরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন। তার গানের মধ্যে সাধারণ শ্রোতারা পেত তাদের মনের ভেতরের কথাগুলো। তিনি গানের লোক ছিলেন। তাই ১৯৭০-৭১ সালে গণসংগীতের দলে যুক্ত হয়ে দেশ এবং জাতির অধিকার নিয়ে রাজপথে গণমানুষের গান গেয়ে বেরিয়েছেন। জিয়াউদ্দিন তারিক আলী আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধকালে পথে-প্রান্তরে বাধ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে গণসংগীত পরিবেশন করে দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার গান শুনে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-জনতা মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে অংশ গ্রহণ করেছে। তিনি গান গেয়ে যেমন পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন তেমনি করে দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থী ক্যাম্পে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থী ক্যাম্পের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। দেশের জন্য এমন একজন মহৎপ্রাণ মানুষ ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। তিনি শুরু থেকেই সীমান্ত পারি দিয়ে অনেকের মতো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে, লিয়ার লেভিন ধারণকৃত সেই দলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ফুটেজ কয়েক দশক পর উদ্ধার করেন। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ এবং তাদের সঙ্গী ছিলেন। নিউজার্সিতে সেই সময় কর্মরত ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্র। তারেক মাসুদের নির্মাণ করা প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান সাধারণ মানুষের কাছে খুবই প্রশংসিত হয়। তারেক মাসুদ নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ দেশের মাঝে এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করে যে, যা দেখে সাধারণ মানুষের মাঝে বিশেষ করে, যুবসমাজের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আরো ধারালো হয়ে ওঠে। তারেক মাসুদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গানে’ মধ্যমণি ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। আজীবন বিপ্লবী সমাজসেবক জিয়াউদ্দিন তারিক আলী সমাজের সর্বস্তরে চেয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব ঘটিয়ে মানুষকে সুন্দরের পথে নিয়ে যেতে। এ কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না যে, তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো চেয়েছেন গানে গানে সব পিছু টানের বন্ধন ছিন্ন করতে। ছায়ানট থেকে শুরু করে বুলবুল ললিতকলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি লতার মতো জড়িয়ে থেকেছেন। তিনি সংগীতকে গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

কাজ-পাগল মানুষ কখনো কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। জিয়াউদ্দিন তারিক আলীও একজন কাজ-পাগল মানুষ ছিলেন। তিনিও কাজ ছাড়া থাকতে পারতেন না। সামাজিক আন্দোলন ছিল তার কর্মক্ষেত্রের আরেকটি দিক। তাই জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মৃত্যু আমাদের সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিরাট এক শূন্যতা নিয়ে আসবে। জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মতো মানুষরা হলেন সৃজনশীল মানুষ। তাদের মতো মানুষরা কেবল সৃজনের গান গেয়ে যান। সৃজনশীল মানুষরা হয়ে থাকেন হৃদয়বান। তাদের হৃদয়ের গভীর গোপনে খেলা করে কেবল মানুষের উন্নয়নের বিপ্লবী চিন্তা-ভাবনা। কোনো ধরনের নেতিবাচক চিন্তাকে সৃজনশীল মানুষরা কখনো হৃদয়ের মধ্যে স্থান দেন না। ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনাকে নিয়ে তারা চলাফেরা করেন বলেই নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আমরা যদি চারদিকে তাকাই তাহলে দেখব যারা সৃজনশীল মানুষ অর্থাৎ যারা নতুন কিছু সৃজন করে থাকেন, তারা সব সময় ইতিবাচক চিন্তা-চেতনাকে সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন।

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে আপন সন্তানের মতো গড়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম। তিনি দেশের অসহায় অধিকারহীন মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন ঠিক ততটাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের। আমাদের উচিত হবে জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর অসমাপ্ত কাজ তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে সমাপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মানুষের মধ্যে আরো দৃঢ়ভাবে ছড়িয়ে দেয়া। তবেই তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরা নিজেদের গড়ে তুলতে পারব এবং মানুষের মাঝে একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সব ক্ষেত্রে মেলে ধরতে পারব।

তাই পরিশেষে এ কথাই বলতে চাই, আমরা তখনই জিয়াউদ্দিন তারিক আলীকে তার যোগ্য সম্মান দিতে পারব, যদি আমরা সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে তার সব প্রগতিশীল কর্মকে আপন সত্তা দিয়ে বিপ্লবী ভালোবাসায় সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারব।

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আইনজীবী ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App