×

জাতীয়

চাপে স্থবির সড়ক আইন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

চাপে স্থবির সড়ক আইন

রাজধানীর সড়ক

ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি পরিবহন শ্রমিকদের পাল্টা হুঁশিয়ারি দিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান রেখে পাস হয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে আইনটি পাস হওয়ার পর গত বছরের নভেম্বর থেকে আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। ট্রাফিক বিভাগও সে হিসেবে আইন প্রয়োগ করার ঘোষণা দিয়েও সচেতনতা ও সহনশীল কৌশল অবলম্বন করে। একপর্যায়ে পরিবহন শ্রমিকদের বাধার মুখে আইনটি সংশোধনের ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও আইনটির সংশোধন কিংবা বিধি কিছুই হয়নি। যার ফলে সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা। কমেনি মৃত্যুর মিছিল। কবে নাগাদ আইনটি বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনটি বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে আটকে আছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন। এই প্রভাবশালী মহলের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহসহ ৬ সদস্য আবার আইন প্রণয়ন কমিটির মধ্যে রয়েছেন। আইনে যে জরিমানার বিধান রয়েছে সেটি কমিয়ে আনার জন্য নানা ভাবে প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে তাদের ইন্ধনে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। একপর্যায়ে সরকার নতি স্বীকার করে আইনটি সংশোধনের ঘোষণা দেয়। এরপর চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আইনটি প্রয়োগ না করে কাগজপত্র নবায়নের সময় দেয়া হয়েছিল। যা করোনা মহামারির কারণে আবার ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, প্রথম দফার সময় শেষে একাধিক মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। তাদের দাবি অনুযায়ী বেশ কয়েকটি ধারার জরিমানা ও শাস্তি কিছুটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে বিধি প্রণয়নকারী কমিটির কাছে। এরপরও বিধির কাজ কবে শেষ হবে সেটি নিশ্চিত নয় কেউ। কারণ নতুন আইন সড়কে প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর পুরনো আইন বাদ দিয়ে অল্প কিছু ধারায় সামান্য পরিমাণে মামলা দিচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। এ অবস্থা বজায় রাখতে প্রভাবশালী মহল আবার নানা ফন্দি আটতে শুরু করেছে। এজন্য পুরনো ৯ দফা নিয়ে আবারো আন্দোলনে নামতে পারে পরিবহন শ্রমিকরা। এজন্য পরিবহন শ্রমিক নেতারা গত সপ্তাহে মিটিংও করেছে বলে সূত্রের খবর। পাশাপাশি করোনার মহামারির অজুহাততো আছেই।

ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে ভোরের কাগজকে বলেন, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে ডিএমপির একাধিক মিটিং হলেও শুরু থেকেই ফিটনেস ও লাইসেন্স ঠিক করতে সময় চেয়ে আসছে মালিক পক্ষ। তাদের ওই দাবি ও করোনার কারণে লাইসেন্সসহ কাগজপত্র হালনাগাদের সময় ৩০ জুন থেকে বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। ফলে ডিএমপি থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মামলা দেয়ার ক্ষেত্রে বড় মাত্রার জরিমানার ধারাগুলো এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। নামে মাত্র টাকার যে ধারাগুলো রয়েছে সেগুলো দিয়েই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। এতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরা সম্ভব নয় বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নেতৃত্বে সম্প্রতি আমরা মিটিং করেছি। খুবই সহনশীল আলোচনা হয়েছে। যে ধারাগুলোর বিষয়ে আমাদের আপত্তি ছিল, সেগুলো জানানো হয়েছে। অনুরোধ করা হয়েছে যেন জরিমানার পরিমাণটা একটু কমিয়ে আনা হয়। বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয় আমাদের ফিটনেস ঠিক করার বিষয়ে বলেছে। আমরাও তাদের ফিটনেসের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি। বাকিটা এখন মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, চালক শ্রমিকদের কাছে সরকার নতি স্বীকার করতে গিয়ে আটকে আছে নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়ন। সভ্য রাষ্ট্রে এটি মানা যায় না। এছাড়াও আইন প্রণয়নে যে ১১ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল সেখানে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ও পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহসহ প্রভাবশালী ৬ সদস্যের কারণে আইনটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অথচ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন সড়ক আইনটি বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, পরিবহন রক্তপ্রবাহের মতো। রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হলে যেমন একজন মানুষের মৃত্যু হবে ঠিক তেমনি সড়কে শৃঙ্খলা না ফিরলে বছরের পর বছর হাজার হাজার প্রাণ ঝড়তেই থাকবে। এর থেকে পরিত্রাণে নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। আমি মনে করি, আইনে যে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে সেটি যুক্তি সঙ্গত এবং জরিমানা না কমিয়ে পুরো আইনটি বাস্তবায়ন করা হোক।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ভোরের কাগজকে বলেন, গত বছরের নভেম্বরে আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এরপর পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে বিষয়টি স্থবির হয়ে যায়। তখন ৬ মাসের সময় নিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকরা। এরমধ্যে করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় বিষয়টি আর সামনে আগায়নি। আমাদেরও আর কিছু জানানো হয়নি। বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে আছে সেটিও আমার জানা নেই। যেহেতু বাস্তবায়নের ঘোষণার পর প্রায় ১ বছর হয়ে যাচ্ছে; সেহেতু আমরা কয়েক দিন আগে বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেউ সঠিকভাবে আমাদের কিছু জানায়নি। এতে আইনটি বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা চিন্তিত।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এরমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি বিধি প্রণয়ন আবারো পিছিয়ে নিতে আগের ৯ দফা দাবি নিয়ে টার্মিনালে মিটিং করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনের সময় সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- যেকোনো মূল্যে সড়ক আইন বাস্তবায়ন হবে। সুতরাং একটি দায়িত্বশীল পর্যায় থেকেও বলতে চাই, যদি সড়ক আইন বাস্তবায়নে কোনো ধরনের বাধা আসে তাহলে আমরাও বসে থাকব না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ওয়ারী) সাইদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, গত বছর থেকেই নতুন সড়ক আইনে মামলা দিচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। তবে, এ ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা থাকায় সড়ক আইনটি পুরোপুরি প্রয়োগ করা হচ্ছে না। কারণ চাইলেই মালিকরা রাতারাতি গাড়ির বডি ও ডকুমেন্টস ঠিক করতে পারবেন না। এজন্য তখন ডিএমপি নতুনভাবে সার্ভার করে নতুন আইনে যে জরিমানার বিধান আছে তার ৫ ভাগের এক ভাগ নিচ্ছে। যাতে জরিমানার পরিমাণটা সহনশীল পর্যায়ে থাকে।

এজন্য সার্ভারে আইনের ধারা অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট টাকা ধরা আছে। পজ মেশিনে ওই ধারায় মামলা করলেই অটোমেটিক জরিমানার টাকা চলে আসে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সব সময় সড়কে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে তৎপর। তবে, মাঝখানে করোনা মহামারির মধ্যে মানবিক কারণে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন থেকে আবার সবাই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মালেক ভোরের কাগজকে বলেন, বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। কয়েকটি ধারার বিষয়ে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছে। আমরা জরিমানা কমানোর একটি সুপারিশ তাদের পক্ষ থেকে পেয়েছি। সে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা হচ্ছে। আইনটি সম্পর্কে বিআরটিএ পর্যালোচনা করে আমাদের একটি রিপোর্ট দিবে। এরপরেই বিধি প্রকাশ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার কারণে দেরি হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। কিছু কিছু কারণে একটু দেরি হচ্ছে। তবে, আমরা সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করে যাচ্ছি। খুবই কম সময়ের মধ্যে বিধি প্রকাশ করা হবে। এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএ-এর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের ২ শিক্ষার্থীর বাসচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের মুখে ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস হয়। এতে সড়কে আইন ভঙ্গে জরিমানা বেড়েছে ১০ থেকে হাজার গুণ। বেড়েছে কারাদণ্ডও। আগের আইনে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর জরিমানা ছিল ৫০০ টাকা। নতুন আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা ২৫ হাজার টাকা। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও এভাবে জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। গাড়ির আকার পরিবর্তন, সড়কে কাউকে আহত, নিহত করার মামলা জামিন অযোগ্য করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App