×

জাতীয়

সারাদেশে ফের শুদ্ধি অভিযানের তাগিদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৫ এএম

সারাদেশে ফের শুদ্ধি অভিযানের তাগিদ

ফাইল ছবি

দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান এক বছর আগে শুরুর পর তা সবমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে কয়েক মাস পরই তা ঝিমিয়ে পড়ে। অভিযানের শুরুতে ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টরা জালে আটকা পড়লে তাদের জবানিতে বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত রাঘববোয়ালদের নাম উঠে আসে। আলোচিত ঠিকাদারসহ শতাধিক ব্যক্তি র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে আটক হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি অর্থপাচারের কয়েকশ অভিযোগ তদন্ত করে সিআইডি। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু কয়েক মাস পর সেই অভিযান গতি হারালে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে। এই এক বছরে অভিযানে ভয়ে গাঢাকা দেয়া কেউ কেউ ফের গুছিয়ে নিয়ে ভিন্নরূপে লুটপাটে জড়িয়েছেন। রাজধানীসহ সারাদেশে অধরা রয়ে গেছেন অপকর্মের হোতা অনেকেই। অভিযান শুরুর পর সরকারের নীতিনির্ধারকরা সারাদেশে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধীরা এখনো অব্যাহত রেখেছে দখল-ইজারা, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, মাদক কারবার, মানবপাচার, তদবির বাণিজ্যসহ নানা রকম সামাজিক অপকর্ম। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টরন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, শুদ্ধি অভিযান থমকে যাবে এমন আশঙ্কা ছিলই। প্রথম থেকেই আশা করা যায়নি অভিযান অব্যাহত রাখা যাবে। কারণ যাদের আটক করা হয়েছে তারা চুনোপুঁটি। এদের মদতদাতা প্রভাবশালী মহল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হওয়ায় তাদেরকে অভিযানের আওতায় আনা হবে না। যেমন ক্যাসিনোকাণ্ড জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় পরিচালিত হয়েছে। অভিযানে চুনোপুঁটি টাইপের কয়েকজন আটক হলেও প্রভাবশালীরা অধরা রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে অনুসন্ধান করে প্রভাবশালী ও রাঘববোয়ালদের নাম প্রকাশ করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে প্রভাবশালীদের নাম আসায় অভিযান বেশিদূর এগোয়নি। তবে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো মনোভাব রয়েছে বলেও উল্লেখ করে আাবারো জোরালো অভিযান শুরুর তাগিদ দেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর প্রথম দিনই রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযান চলে। ওইদিন সন্ধ্যায় গুলশানের বাসা থেকে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগাঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ৬ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সীমান্ত এলাকা থেকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে। সম্রাটের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে রাজধানীর ক্লাবকেন্দ্রিক ক্যাসিনোকাণ্ডের কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির তথ্য বেরিয়ে আসে। এই ক্যাসিনোকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে গণপূর্তের ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের টেন্ডার বাণিজ্য। গ্রেপ্তার হন মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনাকারী এনামুল হক আরমান, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ শফিফুল আলম ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর প্রধান সমন্বয়কারী সেলিম প্রধান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা ময়নুল হক ওরফে মনজু। ক্যাসিনো অভিযান শুরুর পর অনেকেই গাঢাকা দেন। কেউ কেউ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে আত্মগোপন করেন। সূত্র মতে, প্রায় তিন মাস ধরে ক্যাসিনোবিরোধী মোট ৪৯টি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৩২টি র‌্যাব এবং ১৭টি অভিযান পুলিশ পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ২৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ২২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ১১টি ক্যাসিনো ও ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত ক্লাবগুলো হচ্ছে, ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র, কলাবাগান ক্রীড়াচক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব, চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, আবহানী ক্লাব, মোহামেডাম ক্লাব এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ। এরপর আরো বেশ কয়েকটি ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযান শেষ হওয়ার পরে দেশে ফিরেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমান, ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম সোহেল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের ইজারাদার আলী আহমেদ ও গুলিস্তান এলাকার দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুসহ অন্তত ৩০/৩৫ জন। অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভ‚ঁইয়া জামিনে বেরিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ফিন্যানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যাংক হিসাব তলব করে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিন সংসদ সদস্যসহ ২৩ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এসব অভিযানে ৮ কোটি ৪৫ লাখ নগদ টাকা, ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর, ১৩২টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই এবং ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক জব্দ করা হয়। এছাড়া আট কেজি স্বর্ণ, ২২টি অবৈধ আগ্নেয়ান্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় দায়ের করা হয় মোট সর্বমোট ৩২টি মামলা। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি মামলার তদন্ত করে র‌্যাব। এর মধ্যে ১৩টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া এখনো ১টি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া বাকি ১৮টি মামলা তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত করা মামলাগুলোর মধ্যে সাতটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। এদের মধ্যে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভ‚ঁইয়ার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের ৫টি মামলার মধ্যে ৪টির চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ জানিয়েছিলেন, এনু-রুপনের কাছ থেকে জমিসহ ২০টি বাড়ি, ১২০টি ফ্ল্যাট, ২৫ কাঠা জমি ছাড়াও ৯১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ১৯ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ক্যাসিনো অভিযানের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ১৩টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। একটি মামলার তদন্ত চলছে। শিগগির চার্জশিট দেয়া হবে। এদিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে স্থিমিত হলে বৈশ্বিক মহামারি করোনার নমুনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা করে আটক হন সাহেদ ও ডা. সাবরিনা দম্পতি। এরা আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী পরিচয়ে অপকর্ম করে বেড়াতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নকল ‘এন-৯৫’ মাস্ক সরবরাহ অভিযোগে আটক হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার আওয়ামী লীগ নেত্রী শারমিন জাহান। মুজিবকোট পরে দাপিয়ে বেড়ানো হত্যা মামলার আসামি রাজাকার কন্যা লুপা তালুকদার গ্রেপ্তার হয়েছেন অপহরণ মামলায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ কোটি টাকার টেন্ডার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক পদ হারিয়েছেন শোভন-রব্বানী। ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীমকে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঈদের আগের দিন পুলিশের অভিযানে আটক হন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার নাজমুল হাসান লেভী, জেলা শ্রমিক লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বিল্লাল হোসেন ও শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান। এর আগে আটক হন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল, পৌর কাউন্সিলর মামুনুর রহমান, ডিক্রিরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন আবুসহ কয়েক নেতা। তবে রাজনীতির ছত্রছায়ায় অপকর্ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে দাপিয়ে বেড়ানো কয়েক হাজার ব্যক্তি এখনো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে শুদ্ধি থেমে গেছে, তা মানতে নারাজ সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক। তিনি বলেন, শুদ্ধি অভিযান থেমে যায়নি। কৌশলে কাজ চলছে। অনেকের ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে সমন্বয় করে কাজ করছে। একই মত জানিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) ড. মইনুর রহমান চৌধুরী বলেন, শুদ্ধি অভিযান বন্ধ হয়নি, চলমান। কখনো অভিযানের গতি কমে আবার কখনো বাড়ে। যখন সেটা সামনে আসে পুলিশ তা নিয়ে কাজ করে; অভিযান পরিচালনা করে থাকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App