×

জাতীয়

মাঠ প্রশাসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৭ এএম

মাঠ প্রশাসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব!

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বনাম কর্মকর্তা

হবিগঞ্জের একটি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা আর আওয়ামী লীগ করি না।’ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট করে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন- তবুও বলছেন আওয়ামী লীগ করবেন না, কারণটা কী- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা বলেন, মানুষ নানা সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসে। সমস্যার ধরন অনুযায়ী আমি পুলিশের ওসি কিংবা ইউএনওর কাছে নিয়ে যাই। তারা সমস্যার কথা শুনে আইন দেখিয়ে বলে, ‘এটা সম্ভব না, ওটা সম্ভব না।’ প্রশাসনের কথা শুনে মনে হয়, ওসি-ইউএনওরাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। আমরা কিছুই না। এসব কারণে জনগণের সেবা করতে না পেরে মনের দুঃখে বলেছি, আওয়ামী লীগ করি না।

সিলেট বিভাগের একটি জেলায় জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা চলছে। সেখানকার একজন সংসদ সদস্য মাঝখানের চেয়ারে বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক ওই সভার সভাপতি থাকায় তিনিই মাঝখানের চেয়ারে বসেন। সঙ্গত কারণেই সংসদ সদস্যকে পাশের চেয়ারে বসতে হয়েছিল। এর জের ধরে ওই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যার প্রভাব সব কাজের ক্ষেত্রেই পড়তে থাকে।

উল্লেখ্য, স্থানীয় সংসদ সদস্য আইনশৃঙ্খলা কমিটিসহ নানা কমিটির উপদেষ্টা থাকেন। সভাপতি থাকেন জেলা প্রশাসক কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়; দেশের মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে। এর জের ধরে মাঠ প্রশাসনে যে গতিতে কাজ হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, আইন মেনে কাজ করলে তাদের মার খেতে হবে। এজন্য নির্ধারিত কাজকে পাশ কাটিয়ে উপজেলা ও জেলায় কর্মকর্তারা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মানবসেবার কাজে বেশি করে নজর দেন। এতে ফেসবুকে একশ্রেণির লোক দ্বারা বাহ্বা পান মাঠ প্রশাসনের আমলারা। এর বিপরীতে রাজনীতিকরা ভাবছেন, কর্মকর্তারা যদি সরকারি কাজ বাদ দিয়ে সরাসরি জনসেবা করেন তাহলে দেশে আর রাজনীতিবিদের দরকার নেই।

জানতে চাইলে সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে। এরা প্রশাসনকে চাপ দিয়ে কাজ করাতে চায়। এক্ষেত্রে কর্মকর্তারা কথা না শুনলেই সমস্যা তৈরি করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে হবে। নতুবা রাষ্ট্র পরিচালনায় ৩টি বিভাগের যে স্বকীয়তা রয়েছে তা নষ্ট হবে এবং দেশের সর্বনাশ হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনে দ্বন্দ্ব হওয়ারই কথা নয়। সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে উপজেলা প্রশাসনের পিয়ন পর্যন্ত যার যার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে। সেই দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করলেই আর কোনো ঝামেলা থাকে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দায়িত্ব অনুযায়ী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেউ কোনো কাজ করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘অনধিকার চর্চা’ হয়। আর এই অনধিকার চর্চা থেকেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

তবে এই দ্বন্দ্বের কথা মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবীর নানক। গতকাল তিনি এ বিষয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। সুসম্পর্কের আবহে কাজ চলছে। বরং দূরত্ব নিয়ে যেটা বলা হচ্ছে কিংবা প্রচার করা হচ্ছে সেটা কাল্পনিক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটা ঠাণ্ডা লড়াই দীর্ঘদিন ধরেই চলছে।। সম্প্রতি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের ঘটনার পর তা নতুন করে সামনে চলে এসেছে। আমলাদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক চাপমুক্তভাবে প্রশাসন পরিচালনার দাবিটি সামনে চলে এসেছে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা ছিল। ওয়াহিদা খানমের আক্রান্ত হওয়ার পর এ বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ নিয়েও এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে প্রশাসনে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, মাঠ প্রশাসনের সব জায়গায় স্থানীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির খবরটি সঠিক নয়। কিছু কিছু জায়গায় হয়তো কোনো ঘটনা ঘটে। তবে তা সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও রাজনীতিকদের সঙ্গে মিলেমিশেই প্রশাসন চালানো হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, মাঠ প্রশাসনে স্থানীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকলেও সরকারের আমলা নির্ভরতা দৃশ্যমান। গত এপ্রিলে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চলমান ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। দলের কোনো নেতা, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যকে এ দায়িত্ব দেননি তিনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা সংশ্লিষ্ট জেলায় সরেজমিন গিয়ে এবং ভার্চুয়ালি সমন্বয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালিয়েছেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সচিবরা সমন্বয়ের কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের সমালোচনায় কান না দিয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যখন কাজ করবেন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে করবেন। কে কী বলল, কে কী লিখল- সেদিকে কান দিলে কোনো কাজ করতে পারবেন না। আপনারাও কিন্তু জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ। জনসেবা করাটাই হচ্ছে দায়িত্ব।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্থানীয় রাজনীতিকরা মাঠ প্রশাসনকে নানাভাবে ব্যবহার করতে চান। কিন্তু কর্মকর্তারা রাজনীতিকদের খবরদারি মেনে নিতে নারাজ। এ নিয়ে প্রায় সব জেলা-উপজেলায় রাজনীতিকদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। ছাইচাপা আগুনের মতো মাঝে মধ্যে তা জ্বলে উঠে। ঘটে যায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্তমানে সংসদ সদস্য মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, বিভিন্ন কারণে তিনি আর ডিসি অফিসের ভিডিও কনফারেন্সগুলোতে অংশ নেন না। কেন অংশ নেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভিডিও কনফারেন্সে ডিসি মাঝখানের চেয়ারে বসেন। আর তার (ডিসি) পাশের চেয়ারে অর্থাৎ এডিসি মর্যাদায় আমি সেখানে বসতে যাব কেন? এ কারণে যাওয়া বাদ দিয়েছি। তবে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন বৈঠকে তিনি অংশ নেন এবং মাঝখানের চেয়ারেই তিনি বসেন। ডিসি বসেন পাশের চেয়ারে। মাঝখানের চেয়ারে বসার অধিকার আদায়ে তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ বিষয়ে ওই জেলার জেলা প্রশাসক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জেলায় কর্মরত নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন কর্মকর্তা জানান, আমি যখন ইউএনও ছিলাম তখন ওই উপজেলার একজন আওয়ামী লীগ নেতা আমার কাছে আসেন একটি তদবির নিয়ে। তার কথা না শোনায় প্রায় ৩ মাস পর জেলা প্রশাসকের কাছে নালিশ দেন আমি নাকি রাজকারের সন্তানদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছি। নালিশ পেয়ে জেলা প্রশাসক তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৫ দিনব্যাপী চলা ওই তদন্তের সময় আমি কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। তার মতে, এভাবে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মাঠ প্রশাসনে কোনোভাবেই ভালো কাজ করা সম্ভব না।

এদিকে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রতি জেলায় একজন করে সচিবকে সরকার দায়িত্ব দেয়ার পর মাঠ প্রশাসনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনীতিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরো বাড়ে। অথচ ওই আদেশে যাদের যে জেলায় দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাদের অনেকেই ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। নিজের জেলার বাসিন্দা হলেও সংসদ সদস্যরা সচিবদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন।

দায়িত্ব পাওয়া সচিবরা জেলার সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও সমন্বয় করে করোনা ভাইরাসসংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা তত্ত্বাবধান করার কথা। কিন্তু এখানে হয়েছে তার উল্টো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, রাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় সংসদ সদস্যরা মেনে নেননি। এর ফলে কোভিড নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়টা ঠিকঠাকভাবে হয়নি।

বিধি অনুযায়ী খুব একটা কাজ না থাকলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা মনে করেন, তারা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক। সংসদ সদস্যরা আইনপ্রণেতা। তারা মনে করেন, জেলা-উপজেলায় খবরদারি না করলে জনগণ তাদের ভোট দেবে না। কিন্তু আইন অনুযায়ী এটা ঠিক নয়। আর এ কারণে মাঠ প্রশাসনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

সম্প্রতি সাবেক হওয়া এক জেলা প্রশাসক (ডিসি) তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একজন সংসদ সদস্য চান জেলায় প্রধানমন্ত্রীর মতো ক্ষমতা। ডিসি সব সময় যেন সংসদ সদস্যকে প্রটোকল দেন। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। জেলায় প্রশাসনিকভাবে প্রধান হচ্ছেন জেলা প্রশাসক। সংসদ সদস্য থাকবেন সংসদে। সংসদ সদস্যদের কথা না শুনলেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর এর জেরে কাজেরও ব্যাঘাত ঘটে। ফলে জনগণও কাক্সিক্ষত সেবা পায় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App