×

জাতীয়

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের রাশ টানার তাগিদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৪৮ এএম

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের রাশ টানার তাগিদ

কী শিক্ষা দিল করোনা- ২

দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ডেঙ্গু কিংবা কোভিড-১৯ দুর্যোগের সময় ফুটে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর স্বেচ্ছাচার ও নির্লজ্জ বাণিজ্যিক মনোভাব। এর জন্য সেবাগ্রহীতাদের দিতে হয়েছে চরম মাশুল। ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সরকারও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের কমতি নেই। এই সুযোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের আধিপত্য বেড়েছে। মূলত ১৯৯০ সালের গোড়া থেকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিভিন্ন খাতে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতা প্রতিফলিত হয়েছে স্বাস্থ্য খাতেও। বেসরকারি খাতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা যে ভালো নয় সেটিই প্রমাণিত হয়েছে এবার করোনাকালে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে সরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০৭টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে এই সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। সরকারি হাসপাতালের আশপাশেই গড়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই। জানা যায়, দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ১৬ হাজার। তবে নিবন্ধন আছে সাড়ে ৪ হাজার প্রতিষ্ঠানের। যাদের লাইসেন্স আছে তাদের তা নবায়নে আগ্রহ নেই। এছাড়া নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। কিন্তু প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এসব হাসপাতাল দিব্যি রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেই শুরু হয় রোগীদের জিম্মি করা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন স্বাস্থ্য

খাতের দৃশ্যপট কোভিড-১৯ আমাদের সামনে এনেছে। এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের অবহেলার ফল এখন আমরা ভোগ করছি। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে সরকার কখনোই অ্যাকাউন্টেবিলিটি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনতে পারেনি। তাদের স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতকে সে দেশের সরকার কতটা গুরুত্ব দেয় তা বোঝা যায় স্বাস্থ্য খাতে কত টাকা খরচ করছে তার ওপর ভিত্তি করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল হেলথ একাউন্টের তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে খরচ করছে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ মনে করেন, বেসরকারি খাতের বিস্তারের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় কয়েক গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে প্রতি বছর যত টাকা খরচ হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীরা ব্যয় করে। যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

করোনাকালে রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের কেলেঙ্কারির পর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স এবং তা নবায়নের কঠোর নির্দেশনা আসে সরকারের পক্ষ থেকে। নির্দেশ দেয়া হয় ২৩ আগস্টের মধ্যে লাইসেন্স কিংবা তা নবায়ন করতে হবে। এরপর বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকপক্ষের তোড়জোড় শুরু হয়। এ নিয়ে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করে মালিকরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের নির্দেশে এ পর্যন্ত আবেদন করেছে ১২ হাজার প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ধারণা করা হচ্ছে এটি মোট সংখ্যার ৭৫ ভাগ। তবে আবেদন করা অনেক প্রতিষ্ঠানের নেই পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিক লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা ভোরের কাগজকে বলেন, ২৩ আগস্ট লাইসেন্স ও তা নবায়নের তারিখ শেষ হওয়ার পর বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের আরো কিছুটা সময় দিয়েছিলাম। যারা আবেদন করেননি সেই সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পহেলা সেপ্টেম্বর আমরা কারণ দর্শানোর নোটিস দেই। সেই নোটিসের জবাব ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সময় পেরিয়ে গেলেও অনেকেই আবেদন করেননি। আবেদন করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। তিনি জানান আবেদনের বাইরে কোনো বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না।

তবে অন্যান্য বারের মতো এবারো বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা অজুহাত খাড়া করেছেন। তারা বলছেন, এত অল্প সময়ে এত প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। তারা আরো সময় চান। বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মবিন খান জানান, সরকারের দেয়া শর্ত পূরণ করে আবেদন করতে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগবে। এছাড়া সরকারের কিছু শর্ত শিথিলেরও দাবি জানান তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা দীর্ঘদিনের। জনগুরুত্বপূর্ণ এই খাতটি আইনি কাঠামোর বাইরে দায় দায়িত্বহীনভাবে চলতে পারে না। একে অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। সরকারের বিধিনিষেধ ও শর্ত মেনেই তাদের চলতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, যারা এসব হাসপাতাল খুলেন এবং দিনের পর দিন লাইসেন্সবিহীনভাবে হাসপাতাল চালিয়ে যেতে পারেন তাদের খুঁটির জোর অনেক শক্ত। আর সে কারণেই অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নবায়নের জন্য চাপ দিলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক পাত্তা দেন না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা আছে। অনেক সময় প্রশাসনের মদতে কিংবা ম্যানেজ করেই তারা রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যান। এছাড়া এত হাসপাতাল পরিদর্শনের মতো জনবলও নেই অধিদপ্তরের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App