×

মুক্তচিন্তা

করোনায় মন্দের ভালো সুদিনে বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:০৬ পিএম

পার্টি অফিসে বাতি জ্বালানো এবং কর্মসূচিতে শোরগোল করার মতো কর্মী উপস্থিতিও দেখা যায়নি। দর্শক সারিও ফাঁকা পড়ে থাকে। কোনো কোনো দিন দেখা যায় শ্রোতার চেয়ে বক্তার সংখ্যা বেশি থাকে। ভঙ্গুর সাংগঠনিক কাঠামো, দুর্বল নেতৃত্ব এবং মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম।

ডিজিটাল হয়ে উঠছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। আন্দোলনে ব্যর্থতা এবং মামলা-মোকদ্দমায় দৌড়ের ওপর থাকা নেতাদের অনেকে যখন ফোন, ফেসবুক, টুইটসহ ডিজিটালে টাল অবস্থা, তখনো তিনি চলেছেন এনালগে-ম্যানুয়েলে। তার ফেসবুক আইডি নেই বলে জানানো হয়েছিল বারবার। ষড়যন্ত্র করে তার নামে অসংখ্য ভুয়া আইডি চালানো হচ্ছে মর্মে থানায় জিডিও করা হয়েছে।

দেশের বিশাল একটি দলের মহাসচিবের কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুটিই চলছিল। এর মাঝেই টুইটার আইডি খুলে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইউসিহিদে সুগাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। এটি অবশ্যই ব্যতিক্রমী ঘটনা। তা জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য নয়, বিএনপি মহাসচিবের জন্য। সামনে হয়তো তাকে ফেসবুকেও অ্যাকটিভ দেখা যেতে পারে। মির্জা ফখরুল পিছিয়ে থাকলেও করোনা মহামারিতে বিএনপির রাজনীতি এখন পুরোটাই ডিজিটালে।

ভার্চুয়ালে মেলবৈঠক, শলা-পরামর্শ সবই করছেন নেতাকর্মীরা। ঘাটে-মাঠে না থাকলেও মোবাইল ফোনে নিজের কর্মদক্ষতা ও তৎপরতার জানান দিচ্ছেন জায়গামতো। তার চেয়ে বড় কথা করোনাকালে মামলা-হামলা, আদালতে হাজিরা বা নানা জায়গায় লুকানোর দরকার পড়ছে না। যার যার ঘরবসতিতেই আছেন, থাকছেন নিরাপদে। পুলিশ তাড়া করে না। তুলেও নেয় না। এমন স্বস্তি দলটির নেতাকর্মীরা পায়নি গত টানা প্রায় এক যুগে। পালানোর জায়গাও মিলছিল না। কারো কারো সংসারে অশান্তি নেমেছে। পুত্র-কন্যার বিয়ে আটকে গেছে। স্ত্রী চলে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। সেই দুর্গতি থেকে এখন মুক্ত বিএনপি নেতাকর্মীরা।

করোনা মৌসুমের শুরুতেই সরকারের আনুক‚ল্যে কারামুক্তির ভাগ্যবতী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে তার আরো ৬ মাস সাজা স্থগিতের আর্জি মঞ্জুর করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশি-বিদেশি দেনদরবার, তদবির, আদালতে আইনি লড়াই এবং আন্দোলনের যাবতীয় শক্তিহারা হয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ‘আল্লাহ ভরসা’ করা ছাড়া যখন করার আর কিছু নেই, তখনই দেশে করোনার হানা। করোনার ঝুঁকি, বয়স, অসুস্থতা ইত্যাদি মিলিয়ে দেশে করোনা শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই সাজা স্থগিতের মাধ্যমে মেলে খালেদার মুক্তি।

বিএনপি ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ক্ষমতার বাইরে। চেয়ারপারসন মুক্ত থাকলেও কথা বলতে মানা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে বাধা আছে। দলের কাউন্সিল করার সময় পার হয়ে গেলেও তা কবে হবে, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর থেকেই রাজনীতির চরম খাদে পড়ে যায় বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে নির্বাচনও হয়ে যায়। তার মুক্তির ব্যাপারেও তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলনের হুঙ্কার দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। কর্মী সংকট দিনকে দিন প্রকট হয়ে ওঠে। পার্টি অফিসে বাতি জ্বালানো এবং কর্মসূচিতে শোরগোল করার মতো কর্মী উপস্থিতিও দেখা যায়নি। দর্শক সারিও ফাঁকা পড়ে থাকে। কোনো কোনো দিন দেখা যায় শ্রোতার চেয়ে বক্তার সংখ্যা বেশি থাকে। ভঙ্গুর সাংগঠনিক কাঠামো, দুর্বল নেতৃত্ব এবং মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। এ রকম অবস্থায় করোনা গোটা দেশের প্রেক্ষাপটই পাল্টে দেয়।

বিএনপির জন্য তা কিছুটা আশীর্বাদের মতো। কর্মী জোগানো বা জড়ো করার আবশ্যকতা নেই। এর চেয়ে ভোটতলায় ঘোরাফেরাকে আপাতত লাভজনক ভাবছে বিএনপি। নির্বাচনবিষয়ক সব অভিজ্ঞতার আলোকে এখন ভোটের মাঠেই দলটি। জাতীয়, স্থানীয় নির্বাচন, উপনির্বাচনের মাঠে থাকছে। কর্মীদের জন্যও তা স্বস্তিদায়ক-নিরাপদ। ভোটে পরাজয়, নির্বাচনে যাওয়া, না যাওয়া, গিয়ে ফিরে আসা বা বয়কট, ফলাফল প্রত্যাখ্যান তাদের জন্য কিছুটা অক্সিজেন পাওয়ার মতো। এ নিয়ে ছোটখাটো গ্যাদারিং, ভার্চুয়াল মিটিং, টেলিসংলাপে সময়টা মোটামুটি ভালো পার হচ্ছে। মন্দের ভালো হিসেবে এটি কৌশলও তাদের। তা নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় জালিয়াতি করে জয় ছিনিয়ে নেবে সরকারি দল-এমনটি নিশ্চিতের পরও। গতবার গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনায় জেতার পর বিএনপির মেয়ররা উল্টো নাজেহালের শিকার হয়েছেন। সিটি করপোরেশন চালাতে পারেননি। চেয়ারেও বসতে পারেননি ঠিকমতো। মামলার পর মামলায় দফায় দফায় জেল খেটেছেন। এমন জেল খাটার চেয়ে ফেল করা ভালো ছিল বলে অনেকের রসিকতাপূর্ণ মন্তব্য। এমন দুর্গতির বিনিময়েও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা দম নিশ্বাস নিতে পারছে ভোটের মাঠে থাকার সুবাদে। গত জাতীয় নির্বাচনে গোহারার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সংসদে যাবেন না। পরে গেছেন। তবে তিনি নিজে ছাড়া। বগুড়ার পাস করা আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

২০০৯ সালের জানুয়ারির পর জাতীয় বা আঞ্চলিক সব নির্বাচনেই প্রার্থী কম, ভোটার কম, ভোটও কম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসল-নকল মিলিয়ে ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ। এর বেশি দেখাতে পারেনি তখনকার নির্বাচন কমিশন। তাতে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪৬ জনের বিনা চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেবার ক্ষমতাসীন দলের ২৬৫ জন বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। ২০১৮ সালের শেষের নির্বাচনে আরো কম ভোটার হলেও এক দলের সর্বাধিক প্রার্থীÑ ২৯২ জন জয়ী হন। এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যেও কেন বারবার স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের মাঠে থেকে দম বা অক্সিজেন চায় বিএনপি। পাচ্ছেও কিছুটা। বাকিটা নিশ্চিত করে দিয়েছে করোনা। করোনায় ত্রাণ কাজের নামে কিছুটা ঘোরাফেরাও করতে পারছেন নেতাকর্মীরা। গত কয়েক বছরের যাতনার তুলনায় এটাও কম প্রাপ্তির নয় তাদের জন্য। তবে ২০ দলীয় শরিকদের সেখানে বেশ অতৃপ্তির। বিএনপির দেয়া ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয় বা সম্পৃক্ততা না রাখায় তারা অসন্তুষ্ট হলেও চুপ থাকছে। জোট প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তির পর আশার আলো দেখার আশা ছিল শরিকদের কারো কারো। এরপরও অপেক্ষায় আছেন খালেদা জিয়া তাদের ডাকবেন বলে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App