×

জাতীয়

আল্লামা শফীর সাম্রাজ্য বাবুনগরীর কবজায়!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

নেপথ্যে জামায়াতের ইন্ধন

দেশের কওমি মাদ্রাসার অন্যতম প্রধান ঘাঁটি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ এবং হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ে সংগঠনের আমির শাহ আহমেদ শফীর সঙ্গে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর দ্বন্দ্ব বেশ অনেক দিন ধরেই। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত এই আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার নেতৃত্বের ওপর ভর করেই হেফাজতের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। কয়েক দশক ধরে মহাপরিচালকের পদে থাকা ‘বড় হুজুর’ আহমেদ শফী বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতি পদেও ছিলেন। মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-বিক্ষোভের মুখে মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পদ ছেড়ে দেয়ার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আহমেদ শফীর মৃত্যুতে কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্ব ও হেফাজতে ইসলামের সর্বোপরি আহমেদ শফীর সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ জুনায়েদ বাবুনগরীর কবজায় চলে গেছে। সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্য জানিয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমেদ শফীকে অব্যাহতি এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বহিষ্কারসহ ৬ দফা দাবিতে গত বুধবার আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মাদ্রাসার শূরা কমিটির বৈঠকে মহাপরিচালকের পদ ছেড়ে দেন আহমেদ শফী। ওই বৈঠকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক শফীপুত্র আনাস মাদানীকে এবং শফীর অনুসারী আরেক শিক্ষক মাওলানা নূরুল ইসলামকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়। পদ

ছেড়ে দেয়ার পর গুরুতর অসুস্থ আহমেদ শফীকে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরে শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় গতকাল শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় নিয়ে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা যান তিনি।

জুনায়েদ বাবুনগরীর ইন্ধনেই আন্দোলনের সূত্রপাত : জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা আল্লামা আহমেদ শফীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছেন। সূত্র জানায়, বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং অসুস্থ আহমেদ শফীর উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে কয়েক মাস আগে বাবুনগরীর সঙ্গে শফী সমর্থকদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে মাদ্রাসার পরিচালকের পদ থেকে বহিষ্কার হন বাবুনগরী। তবে হেফাজতের মহাসচিবের পদে আছেন তিনি। আর তখন থেকেই তিনি আহমেদ শফীর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে তোলেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। অভিযোগ রয়েছে, জামায়াতের সহযোগিতায় বাবুনগরী নেপথ্যে থেকে নিজে এবং তার অনুসারীরা শিক্ষার্থীদের দিয়ে এই আন্দোলন গড়ে তোলেন।

এ ক্ষেত্রে বাবুনগরীর অনুসারীরা যুক্তি দেখান, বার্ধক্যজনিত কারণে আহমেদ শফী দীর্ঘদিন ধরেই মাদ্রাসার প্রশাসনিক তদারকিতে অক্ষম। একাধিকবার তাকে দেশ-বিদেশে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। নিজের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় আহমেদ শফী দাপ্তরিক কাজে ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর ওপর নির্ভর করতেন। এই সুযোগে আনাস মাদানী হাটহাজারী মাদ্রাসা এবং হেফাজতে ইসলামে নিজস্ব বলয় বাড়াতে তৎপর হন। মাদ্রাসার মহাপরিচালকের ছেলে হিসেবে তিনি প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। তার সুপারিশে নিয়ম ভঙ্গ করে মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ ও বরখাস্ত করা হয়।

বাবুনগরীর নেপথ্যে জামায়াত : নিজের হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি ও তার অনুসারীরা শিক্ষার্থীদের দিয়ে কৌশলে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আর নেপথ্য থেকে বাবুনগরীকে সহযোগিতা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। কয়েকটি গোয়েন্দা সূত্র এবং সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের নেতৃত্বে ও হাটহাজারীর মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের নেপথ্যে জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীদের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।

আহমেদ শফী-জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরোধের কারণ : এক সময় আহমেদ শফী এবং জুনায়েদ বাবুনগরী ছিলেন গুরু-শিষ্য। শতবর্ষী আহমেদ শফী মাঝেমধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবুনগরী ভেবেছিলেন, শফীর পরে তিনিই হবেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি ঢেলে দিয়ে আহমেদ শফী তার ছেলে আনাস মাদানীকে ক্রমেই ক্ষমতাধর করে তোলেন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক ও মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আনাস মাদানীকে। জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে দেয়া হয় মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকেও। এরপর থেকেই আহমেদ শফী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে নিজের গ্রুপকে সক্রিয় করেন বাবুনগরী। হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের আসন ফিরে পেতে এবং মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতেই বাবুনগরী আহমেদ শফীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

আহমেদ শফীর সমর্থক শিক্ষকরা বলেন, জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থক শিক্ষকরা বহিরাগত কিছু লোক মাদ্রাসায় এনে একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করে মাদ্রাসার দখল নিয়েছিল। তারাই আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করেছে। অন্যদিকে বাবুনগরীর পক্ষের দাবি, নানা অনিয়মের কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে মাদ্রাসার ছাত্ররাই বিক্ষোভ করেছে। এই দুই পন্থি শিক্ষকরা এখন একে অন্যের নামে ফতোয়া দিচ্ছেন। আহমেদ শফীর অনুসারীরা বাবুনগরীর গ্রুপকে বলছে কাফের-মুরতাদ, বাবুনগরীপন্থিরা আহমেদ শফীর পক্ষের শিক্ষকদের বলছেন ইসলামের শত্রু!

হেফাজতে ইসলাম ও মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই বিরোধ : আহমেদ শফীর সঙ্গে জুনায়েদ বাবুনগরীর ছিল গলায় গলায় খাতির। দুজনে একসঙ্গে ‘নাস্তিক-ব্লগারদের’ ফাঁসি চেয়েছেন। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া হেফাজতের নেতৃত্বে ছিলেন আহমেদ শফী এবং জুনায়েদ বাবুনগরী। এ দেশের মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে এবং অপপ্রচার চালিয়ে তথাকথিত ‘নাস্তিক ব্লগার’দের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারা। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে লাখো মানুষের সমাবেশের নামে ভাঙচুর-তাণ্ডব চালিয়ে জানান দিয়েছিল নিজেদের শক্তিমত্তা। এমনকি সরকার পতনের হুমকিও উচ্চারিত হয়েছে সংগঠনটির নেতাদের মুখে! সেদিন রাতে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের মুখে হেফাজত কর্মীরা ঢাকা ছাড়লেও বিভিন্ন ব্লগের মাধ্যমে এই সংগঠনের কর্মীদের আস্ফালন অব্যাহত ছিল। কেউ তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলেই তাকে ‘নাস্তিক-মুরতাদ’ ফতোয়া দেয়া হতো। একের পর এক ব্লগারদের কুপিয়ে খুন করার পর হেফাজত নেতাদের উল্লাস করতেও দেখা গেছে।

গত বুধবার আন্দোলন শুরুর পর রাতে মাদ্রাসার শূরা কমিটি বৈঠক করে আনাস মাদানীকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিক্ষুব্ধরা শান্ত হলেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার গুঞ্জনে বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার মাদ্রাসাটি বন্ধের নির্দেশ দেয়।

সরকারি নির্দেশের পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রাতে আহমেদ শফীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার শূরা কমিটি। বৈঠকে ১২ সদস্যের শূরা কমিটির পাঁচ সদস্য এবং মাদ্রাসার প্রবীণ সিনিয়র শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। মাদ্রাসার শূরা কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন নানুপুরী বলেন, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বড় হুজুর। তবে তিনি আমৃত্যু ছদরে মুহতামিম (উপদেষ্টা) হিসেবে থাকবেন। তিনি মাদ্রাসা পরিচালনা ও নতুন মুহতামিম মনোনয়নের দায়িত্ব শূরা কমিটিকে দিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App