×

মুক্তচিন্তা

মনপুরার ফাদার টিম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:৩৭ পিএম

সম্ভবত মনপুরাই বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৌঁছেনি। জুন মাসে মনপুরার দিকে মুখ করে এগিয়ে আসা দুটো লঞ্চ দেখা যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে লোকজন দ্বীপের পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন লঞ্চ ভিড়তেই এগিয়ে গিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন, যুক্তি দেখাবেন। তিনি তার ধর্মীয় জোব্বা ও ক্রস পরে সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ছুটলেন, আর তখনই জীবনে প্রথম আতঙ্কিত হলেন যে সৈন্যরা তো প্রথমে গুলি করবে, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে তার পরে।

বাংলাদেশ এবং বাঙালির বন্ধু ফাদার রিচার্ড ডব্লিউ টিম ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইন্ডিয়ানাতে ৯৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন, ৬০ বছরেরও বেশি সময় তার কেটেছে এই বাংলাদেশেই। ১৯৭০-এর প্রলয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসের পর নটর ডেম কলেজের জীববিজ্ঞানের এই শিক্ষক বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চলে এলেন মনপুরা। তার মনপুরার জীবনকে দুটো অধ্যায়ে তিনিই ভাগ করেছেন। তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক না হলেও আমি তাকে শিক্ষক মনে করেছি, তার বই পড়েছি, তিনিও আমাকে তার ছাত্রই বিবেচনা করেছেন। তাকে শ্রদ্ধা জানাতেই তার স্মৃতিকথার ওপর ভিত্তি করে দুই পর্বের এই রচনা। শুরু করব ২৭ মার্চ ১৯৭১ থেকে, এক সময় পিছিয়েও যাব। এমনিতেই সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত বাঙালি গণপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পরিকল্পিত বিলম্বে অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে উঠেছে। মার্চের প্রথম দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলেন ভয়ঙ্কর তেতে উঠল বাংলাদেশ।

‘রমনাতে দশ লাখ জনতার সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান তার বিখ্যাত রেসকোর্স ভাষণে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক সবচেয়ে প্রতিধ্বনিময় শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন : এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে গেলেন। ‘সে রাতেই ঘটল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম ক্র্যাকডাউনের ঘটনা- উদ্দেশ্য রাতারাতি বাঙালিদের হাঁটু গেড়ে বসাতে বাধ্য করবে, কিন্তু ঘটল উল্টোটা বিপ্লবের আগুনে বাতাস লাগল এবং তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল : সবুজ পতাকার মাঝে লাল বৃত্ত, তার ভেতরে সোনালি মানচিত্র সুপারইমপোজ করা- সর্বত্র উত্তোলিত হলো।’

চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহের কথা শুনে স›দ্বীপগামী জাহাজ দিকবদল করল। আবেগ উন্মত্ত যাত্রীরা প্রতিশোধ নিতে বিহারীর খোঁজ করছে। স্টিমার ভোলার দিকে যেতে থাকল। রাত ৮টার দিকে ফাদার টিম দৌলতখান নামলেন। সেদিন ছিল হাটের দিন। মুখভর্তি দাড়ি, রোদে পোড়া সাদা চামড়া, পরনে আমেরিকান রেডক্রসের চিহ্নযুক্ত সেনাবাহিনীর পোশাক- তারা ফাদার টিমকে পাকিস্তানি সৈন্যই মনে করল এবং ধেয়ে আসল। একজন ডাক্তার দ্রুত তাকে বাহু ধরে টেনে ডিসপেনসারিতে ঢুকিয়ে ফেলে গণপিটুনিতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালেন। ক্ষুব্ধ এবং কৌত‚হলী দুধরনের মানুষ ওষুধের দোকান ঘেরাও করে ফেলল। তিনি আসলে কে বাংলায় বোঝাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু কাজ হলো না। এক সময় সেই ডাক্তারই তাকে বের করে দিলেন, নতুবা ক্ষিপ্ত জনতা দোকান ভেঙে ফেলবে।

তবে ডাক্তার তাকে ত্যাগ করলেন না, তার মুখ বরাবর লণ্ঠন ধরে জনতাকে বললেন, দেখো, ভয়েস অব আমেরিকা রেডক্রসের লোক। সে সময় এদেশের মানুষের কাছে আমেরিকার চেয়ে ভয়েস অব আমেরিকা বেশি পরিচিত। তিনিও তার কাঁধের ব্যাজ, আমেরিকান পতাকা দেখিয়ে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। ঠিক তখনই আওয়ামী লীগের নেতা তাকে টেনে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে এলেন এবং ক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে বললেন, মনপুরার জলোচ্ছ¡াসের পর এই মানুষটি তার রক্ত, ঘাম আর অশ্রু ঝরিয়ে সেখানকার মানুষের সেবা করছে।

কেউ কেউ চিৎকার করে বলল, ব্যাটা তো বাঙালি নয়। ‘তখন আমি ব্যাখ্যা করলাম মুজিবের ডান হাত ডক্টর কামাল হোসেন আমার ছাত্র (যদিও তা নয়) এবং ভোলার এসডিও আমার ছাত্র। তখন হাততালি শুরু হলো, তারা আমাকে নিয়ে জয়ধ্বনি দিল। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে আমি ভিকটিম থেকে হিরো হয়ে গেলাম।’

রাতে আওয়ামী লীগ অফিসে ঘুমিয়ে সকালে নৌকায় মনপুরা রওনা হলেন। হঠাৎ ঝড় ও ঢেউয়ের যে তাণ্ডব শুরু হলো তাতে তার অ্যান্টার্কটিকা গিয়ে পৌঁছার কথা। কাছাকাছি দুটি নৌকা ডুবে গেল, কয়েক ঘণ্টার ঝড়ের তাণ্ডবের পর তার নৌকা মনপুরার উত্তরপূর্বে দিকে রামগতিতে গিয়ে ঠেকল। একটি ভেঙে পড়া স্কুলের চালের নিচে রাতের আশ্রয় নিলেন। কিন্তু মধ্যরাতে হুড়োহুড়ি শুনে ঘুম ভাঙতেই জানলেন, গুজব রটেছে রামগতিতে পাকিস্তানি নৌবাহিনী ঢুকে পড়েছে। কেউ একজন তার মুখের ওপর টর্চ মেরে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘চীন দেশের লোক।’

জীবনে এই প্রথম এবং শেষবারের মতো তিনি নিজেকে এভাবে চিহ্নিত হতে দেখলেন। এপ্রিলের প্রথম দিন তিনি যখন মনপুরা পৌঁছলেন, সবাই ভাবলেন এটা এপ্রিল ফুল কৌতুক না তো? কারণ তারা জানেন নৌকা ডুবিতে ফাদার টিমের মৃত্যু ঘটেছে। আর সে খবর ঢাকা পৌঁছেছে। প্রায় এক মাস পর দাড়ি কেটে যখন স্টিমারে ঢাকায় এলেন তার বিস্মিত সম্প্রদায়ের কাছে এটা মনে হয়েছিল পুনরুত্থানের গল্প তো। মার্ক টোয়াইনের মতো তিনি বলতে পারতেন, আমার মৃত্যুর সংবাদটি অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমার আত্মার সদগতির জন্য না জানি কতটা প্রার্থনা সভা হয়েছে!

নিরাপত্তাসহ নিজের কাজের সুবিধার জন্য তিনি সামরিক সরকারের মেজর জেনারেল সিভিল অ্যাফেয়ার্সের কাছ থেকে তার পরিচিতির একটি সার্টিফিকেট নেয়া প্রয়োজন মনে করলেন। ১২ মে তাকে পাঠানো হলো গভর্নর হাউসে (এখন বঙ্গভবন) একজন পাঞ্জাবি মেজরের কাছে, তারপর কর্নেল নকির কাছে তিনি তাকে মনে করলেন পাঠান। ফাদার টিম বললেন, মনপুরাতে হিন্দুদের ত্রাণসামগ্রী দেয়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কর্নেল নকি বললেন, বৈষম্যের কোনো কারণ নেই। ফাদার টিম বললেন, মনপুরার সরকারি লোকজন সম্ভবত এটা জানে না, কাজেই আদেশটি লিখে দিন। কর্নেল বললেন, প্রয়োজন নেই। তিনি আর দরকষাকষি করার সুযোগ পেলেন না। এমনিতে সেখানে স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকলেও উস্কানির কারণে যুবকদের কেউ কেউ হিন্দু বাড়িতে মাটির চেলা ছুড়ে মারে।

এক সন্ধ্যায় ক’জন হিন্দু তার উত্তর মনপুরার হেল্ক অফিসে (হার্টল্যান্ড ইমার্জেন্সি লাইফ সেভিং প্রজেক্ট) এসে বলল, পুলিশ ত্রাণের কাজে দক্ষিণ ক্যাম্পে আসা ১৮ বছরের একটি যুবককে আটক করেছে তার কাছে থাকা ৮০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং মুক্তির জন্য তাকে আরো ৭০০ টাকা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তিনি তিন মাইল হেঁটে থানায় এসে জোর দিয়ে ওসিকে বললেন, এই দেখুন এই চিঠিতে মেজর জেনারেল আমাকে সাহায্য করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি শুনেছি রিলিফের কাজে আসা একটি যুবককে আপনি আটকে রেখেছেন। আপনি এখনই তাকে ছেড়ে দিন এবং তার ৮০০ টাকা ফেরত দিন, নতুবা আমি ঢাকায় আর্মির কাছে রিপোর্ট করব।

২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ ব্যারাকে আর্মির হাতে কয়েকশ পুলিশ নিহত হওয়ায় পুলিশ আর্মিকে ভয়ের চোখে দেখে। ওসি তৎক্ষণাৎ যুবককে মুক্তি দিয়ে টাকাটাও ফিরিয়ে দিলেন। তারপর ফাদার টিমকে বললেন, মেজর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি ঠিকঠাক কাজ করছি। ওসি জানতেন না বাংলার কসাই টিক্কা খান এই মেজর জেনারেল নন, বরং তিনি বেসামরিক বিষয়ের মেজর জেনারেল। মে মাস ঝড়ের মৌসুম, দ্বীপ ভাসিয়ে নেয়া আর একটা জলোচ্ছ্বাস এলে মানুষ আবার ভেসে যাবে, পাকা কোনো স্থাপনায় আর মানুষ দাঁড়ানোর জায়গা নেই।

মনপুরার বাইরেও হিন্দু নিধনের যে খবর পাচ্ছেন, তাতে তিনি বিচলিত। সেই মে মাসে হাতিয়া গিয়ে দেখলেন, দ্বীপের দক্ষিণাংশে হিন্দু পাড়ার বাড়িঘর ভস্মীভ‚ত এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে সাতজনকে হত্যা করেছে। তিনি ইঞ্জিনচালিত বোটে রামগতি ও চরজব্বার গিয়ে একই রকম ঠাণ্ডা মাথায় খুনের কাহিনী শুনেন। চরজব্বার এসে তিনি একটি ছাপা সরকারি প্রচারপত্র পান, তাতে মৃত্যুযন্ত্রণা ও মৃত্যুভয়ে কাতর মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে তারা যেন স্বাধীন বাংলা রেডিও না শোনেন। ঢোল শহরৎ করেও এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তিনি খোলা চিঠিতে এই বর্বরতার খবর ঢাকা অফিসকে জানালে হেল্প প্রশাসক, সাবেক বড় সরকারি কর্মকর্তা আকবর কবির আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আতঙ্কের কারণ- এই খবর জানানোর অপরাধে সেনাবাহিনী না আবার তার অফিসে চড়াও হয়।

সম্ভবত মনপুরাই বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৌঁছেনি। জুন মাসে মনপুরার দিকে মুখ করে এগিয়ে আসা দুটো লঞ্চ দেখা যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে লোকজন দ্বীপের পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন লঞ্চ ভিড়তেই এগিয়ে গিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন, যুক্তি দেখাবেন। তিনি তার ধর্মীয় জোব্বা ও ক্রস পরে সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ছুটলেন, আর তখনই জীবনে প্রথম আতঙ্কিত হলেন যে সৈন্যরা তো প্রথমে গুলি করবে, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে তার পরে। যতক্ষণ না লঞ্চ দুটি চিৎকার ধ্বনির রেঞ্জের মধ্যে এলো বোঝা যায়নি যে এতে সৈন্য বোঝাই করা হয়নি। এগুলোতে খাদ্যশস্যের ত্রাণ বহন করা হয়েছে। স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর এই প্রথম মনপুরা দ্বীপে খাদ্য সাহায্য পাঠানো হলো।

ফেব্রুয়ারিতে ফাদার টিম মনপুরাতে ফিরে আসার পর দেখলেন মনপুরা ইঁদুরে ছেয়ে গেছে। জলোচ্ছ¡াসে ইঁদুর সব ভেসে গেছে সাগরে- সেই সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ইঁদুরের সব শত্রু-বিড়াল ও সজারু। কিন্তু সবার আগে ফিরল ইঁদুর, নিশ্চয়ই কোনো নৌকায়- প্রাকৃতিক শত্রু না থাকায় অল্পদিনে দ্বীপ ভরে গেল তাদের সন্তান-সন্ততিতে। ইঁদুরের সঙ্গে প্লেগের ভয়- তিনি ঘোষণা করলেন দশ পয়সা করে প্রতিটি মরা ইঁদুরের জন্য পুরস্কার। শুরু হলা দ্বীপের ইঁদুর ধরার নতুন উৎসব। কিন্তু ফাদার টিম ও তার দলের সদস্য বহর পালা করে রাত জেগে ইঁদুর তাড়াতেন। তারপরও সারাদিনের পরিশ্রম এবং ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট শারীরিক উত্তাপ নিয়েও সেবার কাজে বিরতি দেননি।

মনপুরা ও অন্যান্য স্থানে যে ত্রাণ সহায়তা বিদেশ থেকে এসেছে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অবিবেচনাপ্রসূত, যে খাবার তারা কখনো খাবে না তাই পাঠিয়েছে যে পোশাক নারী পরবে না তাও এসেছে (বন্যা ত্রাণ কাজে অংশ নিয়ে আমি এমন বস্তাও পেয়েছি যার ভেতর কেবলই বিশাল আকৃতির নারীর বক্ষবন্ধনী)।

তার কথিত ডুবে মারা যাবার ঘটনার পর যখন ঢাকায় এলেন শুনলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চাকরিরত আমেরিকানদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি এপ্রিলেই ঢাকা ছেড়ে দেশে ফিরে গেছেন। তেহরানে অবস্থানরত রোহডস পরিবারের কাছে তিনি জেনেছেন সিয়াটোর ডাক্তাররা (তাদেরই প্রকল্প মহাখালী কলেরা হাসপাতাল, পরবর্তীকালে আইসিডিডিআরবি) সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির কাছে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য আইউইটনেস-চাক্ষুস সাক্ষীর বিবরণী উপস্থাপন করবেন। আর সরকারের যা ভাষ্য তা হচ্ছে লাই-উইটনেস-মিথ্যে সাক্ষ্য। চাক্ষুস সাক্ষীদের একজন ডাক্তার রোহডস। সিনেটর ফুলব্রাইট গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের যত না অবহিত করছে তার চেয়ে বেশি তিনি জানতে পারছেন ডাক্তার রোহডস প্রমুখের নিকট থেকে। সিনেটর চার্চ, ফুলব্রাইট, সিসিংটন, প্যাস্টর, কুপার প্রমুখকে যারা প্রকৃত তথ্য জানাচ্ছেন তাদের এখন ফাদার টিম। ২১ জুন ফাদার টিম সিনেটর ফুলব্রাইটকে যে চিঠি লিখেন তার অনুলিপি দেন বাংলাদেশের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারশ্যান্ডকে। বেশি প্রকাশ্যে এলে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বের করে দেয়া হতে পারে সে আশঙ্কাও ছিল। তবুও তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনকে আগে থেকেই অবহিত করেন। দলনেত্রী জুডিথ হার্ট পাকিস্তান সরকারের ‘সবকিছু স্বাভাবিক আছে’ এ দাবির সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি সাংবাদিক আসার অনুমোদন চাইলে ইয়াহিয়া খান এ ফাঁদে পা দেন। আর বিদেশি সাংবাদিক এলে মাঠে যদি ফাদার টিমের মতো মুক্তিবাহিনীর প্রতি সহানুভ‚তিশীল মানুষ থাকেন পাকিস্তানের কফিনে আরো একটি কফিন মারা হয়ে যায়। তাই হলো।

মনপুরা অভিজ্ঞতা থেকে ফাদার টিম লিখেছেন সমবায় পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা গেলে তা টেকসই হয়; মনপুরাতে গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টি ছিল একটি ব্যয়বহুল ভ্রান্তি, তার চেয়ে কিল্লা বা সাইক্লোন সেল্টার সাধারণ মানুষ বেশি পছন্দ করেছে। আর ত্রাণ সহায়তার শুরুতে কিছু খাবার ও পোশাক দরকার হলে শীতকালীন আমন ও কৃষি পুনর্বাসনে সহায়তা হচ্ছে প্রকৃত সাহায্য।

সে সময় জীববিজ্ঞানের গবেষণায় সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য তার কাছে অনেক আমন্ত্রণ আসে, থাইল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু ২২ জুলাই ১৯৭১ তার কর্তৃপক্ষকে লিখলেন, তিনি দুস্থ মানুষের সঙ্গে মনপুরাতেই থেকে যেতে চান। তার লেখা থেকে তুলে ধরছি :

রাতের বেলা আমরা রেডিও বাংলাদেশের সম্প্রচার (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) শুনতাম। তারা ‘জয় বাংলা’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতেন এবং এই গানেই সম্প্রচার শেষ হতো। আমি যতবারই এই গান শুনেছি আমার হাতের পশম দাঁড়িয়ে যেত। এই গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পাওয়ার জন্য বাঙালিরা স্বাধীন হওয়ার অধিকার রাখে। অবশ্য স্বাধীনতার পর রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। পাকিস্তানিরা রেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানসহ বাঙালি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো পদ্ধতিগতভাবে উৎখ্যাত করে চলছিল। মনপুরার সঙ্গে মিশে আছে একাত্তরের বন্ধু, ছয় দশকের বাংলাদেশ সেবক ফাদার টিমের স্মৃতি।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App