×

মুক্তচিন্তা

নারীকে মাতৃত্ববোধ আর গুণে মূল্যায়ন করতে শিখুন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:১৭ পিএম

আমরা ভুলে যাই সমাজের নানা প্রতিক‚লতা ও অসঙ্গতির মাঝেও একজন মা তার সন্তানকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ব্রত থাকেন। এমন দৃষ্টান্ত নারীর প্রতি বৈরী দৃষ্টিসম্পন্ন এই সমাজে প্রচুর। একজন মা সন্তানকে নিয়ে কী ভাবছেন, কী চেষ্টা করছেন এমন ঘটনাকে অনুপ্রেরণার দৃষ্টিতে না দেখে, প্রশংসিত না করে আমরা কেবল সেই নারীকেই দেখি, তার কাজের, জীবনাচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদের সমালোচনা করি।

একজন মা খেলার মাঠে তার ছোট্ট ছেলেকে ক্রিকেট খেলা শেখাচ্ছেন। মা বল করছেন আর ছেলে ব্যাট করছেন। নিশ্চয়ই খুব সুন্দর একটা দৃশ্য। মা ও সন্তানের এমন সম্পর্ক দৃশ্য মনে শান্তি এনে দেয়ার কথা। কিন্তু অনেকে শান্তি পেয়েছেন যেমন সত্য, তেমন অনেকেই শান্তি পাননি। বরং অশান্তি আর অস্বস্তিতে তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। কারণ ঘাঁটলে যে বিষয়টি উদ্ধার হয় তাহলো এক্ষেত্রে মায়ের পরিধানে বোরকা। আজ যারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন তারা হয়তো এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন না যদি না এখানে দেখা যেত যে, মা ট্রাকস্যুট কিংবা জিন্স-টপস পরে ছেলেকে খেলা শেখাচ্ছেন। আমার এই মতের সঙ্গে ক’জনা একমত পোষণ করবেন জানি না। তবে এটা বাস্তব অভিজ্ঞতা যে, পোশাক এই সমাজে বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ক্ষমতা পেয়েছে। যে ক্ষমতা দিয়েছে প্রচলিত ও বিদ্যমান অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও গোঁড়ামিপনা।

বলতে দ্বিধা নেই দেশে বিদ্যমান যে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার যেসব বিষয়বস্তু কিংবা কারিকুলাম তাতে সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠা, জেগে ওঠার সুযোগ নেই। এই গল্প বহুদিনের। ধর্মীয় গোঁড়ামিপনা, কুসংস্কার এবং পুরুষতান্ত্রিকতার নাগপাশ ছিন্ন করে নারীরা বেরিয়ে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে এলেও অনেক নারী ও পুরুষের ভেতর নেতিবাচক আবহটা এখনো রয়ে গেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব ও মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি, আসেনি। আধুনিক বিশ্বের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আজো তারা নারীর মূল্যায়নে পশ্চাৎপদ। এগিয়ে আনার উপযুক্ত শিক্ষা নেই। কিংবা পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার এ হতে পারে এক ধরনের কঠিন নেতিবাচক ফলাফল। অধিকাংশ মানুষ যা শিখছে তা কেবলই পুথিগত শিক্ষা। কাগজ-কলম, সংলাপ, স্থাপনা ও উদ্ধৃতিতে সভ্যতা নামক একটা নাদুসনুদুস শব্দের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও সামাজিক মূল্যবোধ শব্দটা তাই আজো রুগ্ন রয়ে গেছে মানুষের জীবনাচরণে।

সমাজ কী ভাবে বিষয়টি নিয়ে সেই কৌত‚হল হলো। মা ও সন্তানের খেলার এই বিষয় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর পেরুনো একজন ৩৫ বছরের পুরুষকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে দেখছেন বিষয়টি। উত্তর তার ঠোঁটের আগায় ছিল। তৎক্ষণাৎ উত্তর, মোটেও ভালো নয়। যুক্তি তার, কুরআনে হাফেজরা কখনো এভাবে খেলতে পারে না। তারপর ওপর সে একজন নারী। তার উত্তরে ধাক্কা খাবার মতো অবস্থা। জানতে চাইলাম ইসলাম ধর্মের কোথায় এই বাণী বা হাদিস লেখা আছে? তিনি জানান জানেন না। তবে তিনি শুনেছেন।

কোথা থেকে এমন কথা তিনি শুনতে পারেন পাঠক নিশ্চয়ই তা আন্দাজ করতে পারছেন। যেসব ওয়াজ মাহফিল ও ধর্ম প্রচারণার আয়োজন ও অনুষ্ঠান হয় বা হচ্ছে তার কয়টায় ধর্মকে পরিপূর্ণ ও নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয় তা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে। রয়েছে বিতর্ক। ইসলাম ধর্মকে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিকভাবে উপস্থাপনে একটা বিশেষ শ্রেণি সবসময় সক্রিয় ও তৎপর। ধর্মকে তারা ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন না, উগ্র আচরণ করে বসেন। বহু সময়ে এই শ্রেণি স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনের বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরো একটা ঘটনা বলি। পোশাক-পরিচ্ছদে পরিপাটি ষাটোর্ধ্ব একজন শিক্ষিত পুরুষ, যার দুটি মেধাবী কন্যা সন্তান সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। নারীর প্রতি নিকৃষ্ট পুরুষের লাগামহীন যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা, সংকীর্ণ মনোভাব প্রসঙ্গে পুরুষটি বললেন, নারীর পোশাক খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পুরুষকে সভ্য ও শান্ত রাখার জন্য। উন্নয়ন সংস্থায় বহুদিন কর্মরত পুরুষের মুখে এমন কথা শুনে উচ্চতর ধাক্কা খেতে হলো। তার কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তিনি উত্তর করলেন এভাবে যে, নারীর পোশাক ছোটখাটো (টাইট টপস, ফতুয়া, স্কার্ট, জিন্স প্যান্ট ইত্যাদি) হলে তিনি নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল রাখতে পারেন না। পুরুষ হিসেবে স্বাভাবিক থাকা বেশ কষ্ট হয় তার পক্ষে। ভাগ্যক্রমে তার দুটি কন্যা সন্তানের সঙ্গে একদিন সাক্ষাৎ হলো। মেধাবী ও পোশাকআশাকে তারা বেশ আধুনিক। পিতাপুরুষের ধ্যানধারণার আশপাশে নেই।

এ রকম বিচিত্র গল্প আছে। বিচিত্র ধ্যানধারণা আছে। একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে। যা নেই তা হলো একটা সুস্থ ধারণা, মানসিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানের উপযুক্ত শিক্ষা, চেতনা। একজন নারীকে কীভাবে দেখতে হয় বা হবে, সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান আর শিক্ষা নিয়ে কতজন বেড়ে উঠছে। গণনা করলে সংখ্যা চোখে পড়ার মতো হয় না, হবে না। কারণ কী এমন প্রশ্নে সমাজ আঙুল তোলে পরিবারের দিকে। সমাজ অধিপতিরা বাক্য ছুড়ে মারে পরিবারের দিকে। বলে, পারিবারিক শিক্ষার অভাবে এই দশা। পরিবারকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেখার এই প্রবণতা যে সমাজ কাঠামোর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে, এই সত্য বেমালুম মাথায় থাকে না তাদের। পরিবার ছাড়া সমাজ হয় কী করে? নামতা মুখস্থ করার মতোই তো সবাই এই সত্য শিখে বড় হচ্ছে, পরিবার, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়েই তো সমাজ, তাহলে? সমাজের অব্যবস্থাপনা, অসংলগ্নতা, অনৈতিকতা ও অনিয়ম যে একটা পরিবারকে নষ্ট করতে পারে, পরিবারের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে যে অস্থিতিশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে দিতে পারে, এমন চিন্তা ও সত্য উপলব্ধি নেই যেন কোথাও মস্তিষ্ক, গবেষণা কিংবা উন্নয়ন পরিকল্পনায়।

আমরা ভুলে যাই সমাজের নানা প্রতিক‚লতা ও অসঙ্গতির মাঝেও একজন মা তার সন্তানকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ব্রত থাকেন। এমন দৃষ্টান্ত নারীর প্রতি বৈরী দৃষ্টিসম্পন্ন এই সমাজে প্রচুর। একজন মা সন্তানকে নিয়ে কী ভাবছেন, কী চেষ্টা করছেন এমন ঘটনাকে অনুপ্রেরণার দৃষ্টিতে না দেখে, প্রশংসিত না করে আমরা কেবল সেই নারীকেই দেখি, তার কাজের, জীবনাচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদের সমালোচনা করি। বিরূপ মন্তব্য করি। কী অদ্ভুত! এই সমাজে সরকারি, বেসকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত যোগ্য নারী যেমন তার সন্তানকে বড় করেন, বড় করার স্বপ্ন দেখেন ঠিক তেমনি স্বল্প শিক্ষিত কিংবা শিক্ষার স্পর্শ পাননি এমন একজন শ্রমিকনারী যেমন- পরিচ্ছন্নতা কর্মী, দিনমজুর, গৃহকর্মী এমনকি যৌনকর্মীও তার সন্তানকে বড় করার স্বপ্ন দেখেন। তাদের সন্তানদের অনেকেই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। অথচ তাদের এই সাফল্যকে আমরা পুরস্কৃত করি না, একজন শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে তারা সমাজে কখনোই সমাদৃত হন না। বিশ্ব মা দিবসে এদের গল্প উপস্থাপিত হয় না। কোনো বাণিজ্যিক কোম্পানি তাদের প্রচারে এমন মায়েদের কথা ভাবে না। তারা ছুটে পরিপাটি, আধুনিক ও অভিজাত সমাজে।

শিক্ষাদীক্ষায় চেতনার মূল জায়গায় না থাকার কারণে নারী আজো সমাজে ভোগের বস্তু, তার যতই গুণ থাকুক না কেন। তাই নারীকে একজন ‘মা’ হিসেবে দেখে পবিত্র অনুভ‚তি অনুভবের সুযোগ কোথাও সৃষ্টি হয় না, হচ্ছে না আশানুরূপভাবে। এই সত্য বোধের অভাব প্রবল। পরিশেষে বলি, একজন মা শাড়ি, জিন্স প্যান্ট-শার্ট, স্কার্ট-টপস, সালোয়ার-কামিজ, বোরকা যেটা তার পছন্দ সেটাই পরিধান করেই তার সন্তানকে বেড়ে উঠতে সহায়তা করবেন, তাতে সমাজ বা কার কী এসে যায়। কিচ্ছু এসে যায় না। কেউ এর সমালোচনা করতে পারেন না। যদি কেউ করেন তাহলে এটা হবে তার চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখা দরকার। পুরুষ কিংবা নারী যে-ই হোক তার আচরণ, জীবনাচরণ অশোভন কিংবা অশ্লীল কিনা, যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সমাজকে নষ্ট করে দেয় বা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে সেটাকেই আলোচনা ও সমালোচনায় আনা দরকার সামাজিক মূল্যবোধকে সুরক্ষিত করার জন্য, পোশাক নয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App