×

সাময়িকী

বাবলি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:৪০ পিএম

বাবলি

ক্লাস নাইনের ক্লাসটা যেমন নেবে ভেবেছিল, তেমন হয়নি। ইচ্ছে ছিল ক্লাসে ঢুকেই রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন বোর্ডে লিখবে এবং সবাইকে তা লিখতে বলবে : পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে শাখা আবার চায় কি তাহার পানে।

কিন্তু লাইনগুলো ভুলে গেল, অন্য কোনো কবিতার লাইনও মনে পড়ল না। যখন ক্লাস শেষ হয় হয় তখন মনে পড়ল এবং বোর্ডে লাইন দুটো লিখে দিয়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। টিচার্স রুমে ফিরে যেতেই হেডস্যারের রুমে যাবার সালাম এলো। ভেতরে গিয়ে দেখে হুদাল্লিল মুত্তাকিন স্যারও বসে আছেন। হেডস্যার বললেন, সুপ্রিয়া আমার একটু কাছে এসো তো। সুপ্রিয়া সামনে গিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হেডস্যার নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ান। তার মাথাটা বাম হাতে ধরে বলেন গালটা ঘোরাও তো। গালটা ঘোরাতেই তিনি বলে উঠেন, ওহ্ মাই গড, এত আঁচড় কেন? সুপ্রিয়াও অবাক হয়, কিসের আঁচড় স্যার?

হেডস্যার বললেন, আমার বাথরুমে ঢুকে আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে একটু দেখ। সুপ্রিয়ার প্রথম মনে হলো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। নিজের চোখ কচলালো, কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে থ হয়ে রইল। মাথাটায় চক্কর লাগল। অনেকটাই কাত হয়ে যখন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছিল দীর্ঘদেহী হুদাল্লিল মুত্তাকিন এসে তাকে ধরে ফেললেন এবং একাই হাঁটু ও পিঠ বরাবর হাত ঢুকিয়ে তাকে এনে থ্রি-মিটার সোফাতে শুইয়ে দিলেন, টিচার্স রুম থেকে একজন নারী শিক্ষককে ডেকে এনে বললেন পরনের কাপড়গুলো আলগা করে দাও, মাথায় বাতাস দাও। দু’তিন মিনিট পর জ্ঞান ফিরে আসবে। জ্ঞান সত্যিই ফিরল। সুপ্রিয়া উঠে বসতে চেষ্টা করলে হুদাল্লিল মুত্তাকিন বললেন, কি হয়েছে বল? আমি প্রহল্লাদের সাথে কথা বলেছি, ও বলল গত দেড় মাস তোমাদের দেখা হয়নি, এটা কি সত্যি?

সুপ্রিয়া বলল, জি¦ স্যার আটচল্লিশ দিন। তাহলে গালের এই আঁচড়ের দাগগুলো তার দেয়া নয়? তাহলে কে দিল? সুপ্রিয়া হতবিহ্বল অবস্থায় গতরাতে মশারি বেয়ে টিকটিকির মতো নেমে আসা লেংটা কন্যাশিশুটির কথা বলল, স্বপ্নে তার গালে আঁচড় লেগেছে কিন্তু সে সংস্কারমুক্ত মানুষ, স্বপ্নের শিশুর আঁচড় তার গালে থাকবে এটা বিশ্বাস করে না; বিশ্বাস করলে তার শিক্ষা মিথ্যে হয়ে যাবে।

ততক্ষণে লেডি কলিগদের সহযোগিতায় সে পেটিকোটের ফিতে টাইট করেছে, শাড়ির গিঁট ঠিক করেছে ব্লাউজ ও ব্র্যাশিয়ারের হুক লাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হুদাল্লিল মুত্তাকিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আজকের বাকি দুটো ক্লাস করানোর দরকার নেই। তুমি কি হোস্টেলে ফিরবে না বাড়ি যাবে? বুজেশুনে বলো। সুপ্রিয়া তার স্বাভাবিক স্বর ফিরে পেল। বলল, কি যে বলেন স্যার। বাসায় যাব কেন। আমার বাকি ক্লাস দুটো করাব, তারপর হোস্টেলে ফিরে যাব। হেডস্যার বললেন, ক্লাসগুলো পরে নিয়ো। রাতে একজন বুয়া তোমার সাথে থাকবে, আমি বলে দিচ্ছি।

সন্ধ্যা হতে হতে লেংটা মেয়ে বাবুর কাণ্ড এবং সুপ্রিয়া ম্যাডামের গালের দাগের গল্প হোস্টেলের সবার জানা হয়ে যায়। এ নিয়ে হাসাহাসিও হয়। ক্লাস টেনের দুই যমজ বোন রুবাইয়া ও রুকাইয়া এসে সুপ্রিয়াকে বলে, ম্যাডাম বুয়ার দরকার নেই। আমরা দু’জন আপনার সাথে থাকব। লেংটা বাবুটাকে আমরা ধরে ফেলব। সমস্যা নেই আপনি ঘুমোবেন।

বুয়া হোস্টেলে থাকলেও সুপ্রিয়ার রুমে ছিল না। ছিল দুই বোন। মশারিটা টাঙ্গায়নি, কাজেই মশারি বেয়ে নেমে আসার সুযোগ আর থাকল না। তবে মশার কামড় থেকে শরীরের উদোম অংশ বাঁচাতে মাথার দিকে এবং পায়ের দিকে দুটো কয়েল জ¦ালিয়ে রাখা হলো। ম্যাডামের দু’দিকে দু’বোন- একদিকে দেয়াল ঠেস দিয়ে বসা রুবাইয়া আর অন্যদিকে টেবিলে ঠেস দেয়া রুকাইয়া সিদ্ধান্ত নিল শোবে না, এভাবে বসে থাকতে থাকতে

ফজরের আজান পড়বে। পরের দিন শুক্রবার। কাজেই নাস্তার পর একটা ঘুম দিয়ে পুষিয়ে নেয়া যাবে। রাত তিন কি সোয়া তিনটার দিকে দু’জনই যখন ঝিমোচ্ছে সুপ্রিয়া ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে বলল, ‘আঁচড় দিয়েছে’। দু’জনই এক ঝটকায় উঠে পড়ে, জিজ্ঞেস করে, কোথায়? কোথায় লেংটা বাবু?

সুপ্রিয়া বলল, সরি স্বপ্ন দেখছিলাম। তোমরা ঘুমিয়ে পড়। সুপ্রিয়া তখনই ঘুমিয়ে পড়ল, ছোট বিছানাতে তার গা ঘেঁষে দুই বোনও শুয়ে পড়ল। ফজরের পরপরই সুপারের রুমের সামনে অনেক পায়ের শব্দ। ব্যাপারটা কি বোঝার জন্য ফজরের আজানের সাথে সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন হুদাল্লিল মুত্তাকিন স্যার। হোস্টেলের গুটিকয় মেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে তারাও হাজির।

সম্ভবত পায়ের শব্দে দু’বোনের কেবল লেগে আসা চোখ আমার খুলে যায়। দুই বোনই দরজা খুলে বেরিয়ে এবং স্কুলের সবচেয়ে মুরব্বি স্যারকে দেখে তারাও অবাক হয়। তিনি কিছু বলার আগেই দুই বোনের একজন বলল, আমরা দু’জন থাকব বলে আয়াকে রাখিনি। আমরা তো বসেই ছিলাম। কই কিছুই তো হলো না। স্যার, ব্যাপারটা ভুয়া। ঠিক তখনই রুমে ভেতর থেকে চিৎকার শোনা যায়।

দুই বোন এবং এমনকি স্যার ভেতরে ঢুকে আবছা আলোতে দেখেন সুপ্রিয়া বিছানায় উঠে বসে আছে। বুবাইয়া হাতড়ে হাতড়ে সুইচ অন করতে রুম আলোতে ভরে যায়। হুদাল্লিল মুত্তাকিন জিজ্ঞেস করেন, সুপ্রিয়া কেমন আছো। সুপ্রিয়া বাম গালটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখুন স্যার একটু আগে আঁচড় দিয়েছে। স্যার দেখলেন, দুই বোনও দেখল, মোটেও মিথ্যে বলেনি হোস্টেল সুপার। তার বাম গালে একই রকম আঁচড়।

মুত্তাকিন স্যার চকিতে বসে থাকা হতভম্ব সুপ্রিয়ার মাথায় হাত রেখে একবার বাম গালের দিকে একবার ডান গালের দিকে তাকিয়ে বললেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না। সেদিন আর স্কুলে না গিয়ে সুপ্রিয়া স্যুটকেস গুছিয়ে রিকশা ভ্যানে চড়ে তেরো কিলোমিটার দূরে প্রহল্লাদের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখে বড় দরজায় ছোট্ট একটি টিপতালা। সুপ্রিয়া রেগে যায়- এটুকু কাণ্ডজ্ঞানও মানুষটার নেই, হাত দিয়ে জোরে টান দিলেই তো ভেঙে যাবে। ঘরে টেলিভিশনটা তো দামি, ছোটখাটো আরো কত জিনিস আছে।

ডিউটি ডাক্তার নাসিমা বেগম একটি পর্দার আড়ালে মেয়েটিকে নিয়ে একটুখানি দেখেই বেরিয়ে এসে আপনাকে তিরস্কার করতে শুরু করল; আপনি কিসের টিচার হয়েছেন? আপনাকে কে মেয়েদের হোস্টেলের সুপারভাইজার বানিয়েছে? বেসিক হেলথ এডুকেশন নেই আপনার, কী আশ্চর্য! এমন হলে যদি হাসপাতালের আনতে হয় তাহলে ডেইলি এমন পাঁচশ মেয়ে অ্যাটেন্ড করতে হবে।

নিজের স্যুটকেস ঘরের দরজার বাইরে রেখে সুপ্রিয়া একটু পিছিয়ে আসে, বাড়িওয়ালার মেয়ে স্বর্ণার নাম ধরে ডাকে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর বেরিয়ে আসে তার ছোট বোন অপর্ণা- তাকে দেখে, ‘দিদি আপনি এখানে’। বলে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার দিকে এগোয় না। সুপ্রিয়া ডাকে, অপর্ণা এদিকে এসো, শোনো। অপর্ণা এক পা দু’পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি সুপ্রিয়া দি? হ্যাঁ, কেন, দুই গালে দাগ সে জন্য অন্য কেউ মনে হচ্ছে? ঠিক তা নয়, আপনি শ্মশান থেকে উঠে আসেননি তো? শ্মশান কেন, ঐ তো দরজায় আমার স্যুটকেস। তোমার প্রহল্লাদ দাদা কোথায়? দরজায় এত ছোট টিপতালা কেন?

অপর্ণা আশ্বস্ত হয় সুপ্রিয়া শ্মশান থেকে উঠে আসেনি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে এবং বলে, প্রহল্লাদ দাদা কি মিছে কথা বলেছেন? বলেছেন, আপনার মৃত্যু হয়েছে। তাতেই তো ভরসা পেয়ে স্বর্ণা গতরাতে দাদার সাথে ভেগেছে বাবা খুব রেগে আছে, ফিরে এলে স্বর্ণাকে খুন করবে। এখন প্রহল্লাদ দাদার বিরুদ্ধে অপহরণ মামলার মুসাবিদা করছে। ঘরের জিনিসপত্র বের করে সব দোতলায় উঠিয়ে টিপতালা মেরেছে আর ঐ দেখুন ‘টু লেট’-ও লাগিয়ে দিয়েছে। পরপরই বলল, বিড়াল পুষতেন বুঝি? বাঘা বিড়াল? ভুলেও বাঘা বিড়াল পুষবেন না। এমন দু’গালে আঁচড় বাঘা বিড়াল ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারে না।

সুপ্রিয়া বলল, তাহলে আমি এখন উঠব কোথাও? অপর্ণা বলল, তাহলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে আসি। একটু পরই রাশভারী বয়স্ক মানুষটি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নিচে সুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে অশ্লীলভাবে বললেন, নিজে সুখ দিতে পারিস না বলে ঐ বদমাশ প্রহল্লাদটাকে স্বর্ণার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিস? হারামজাদি এই মামলায় তুই হবি দুই নম্বর আসামি। সুপ্রিয়া গার্লস স্কুলে বা হোস্টেলে আর ফিরে আসেনি।

নারী শিক্ষকদের কেউই আর সুপারের দায়িত্ব নিতে রাজি হলো না। ততদিনে লেংটা বাবু কাহিনী ছাত্রীদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলল এবং পরের তিন মাসে একুশজন ছাত্রী গার্লস হোস্টেল ছেড়ে চলে গেল।

যেহেতু আগের দু’জন পুরুষ সুপারের কারোই লেংটা বাবুজনিত কোনো সমস্যা হয়নি, দু’জন ছেড়ে গেছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন ব্যক্তিগত কারণে (একজনের বেলায় তার গায়ে ঋতুস্রাব চলতে থাকা কোনো ছাত্রীর ছায়া পড়লে নাপাক হয়ে যাবার আশঙ্কা, অন্যজনের বেলায় প্রেম ও যৌনাচার), আরো অন্তত তিনজন পুরুষ শিক্ষক গার্লস হোস্টেলের সুপার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, একজন তো রীতিমতো তদবিরও করিয়েছেন। কিন্তু আমাদের হেডস্যার তোফাজ্জল হোসেন রাজি হননি। দু’একজন সম্পর্কে এটাও বলেছেন, শেয়ালকে তো আর মুরগির পাহারায় রাখা যায় না।

যখন কেউ থাকেন না, সুপারের পদ খালি থাকে তখন চলে কি ভাবে? উপরের ক্লাসের। সম্ভব হলে হোস্টেলে যদি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কেউ থাকে তাদের একজনকে হোস্টেলের ক্যাপ্টেইন বানিয়ে দেয়া হয়। ক্লাস ক্যাপ্টেইনের মতো সে চালিয়ে নেয়।

এর মধ্যে বিব্রতকর ঘটনাটি ঘটল। আত্মহত্যা করার জন্য ক্লাস নাইনের রুমানা এক বোতল স্যাভলন খেয়ে ফেলল। ছাত্রীরাই তাকে রিকশা-ভ্যানে তুলে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে নিয়ে গেল এবং সুস্থ করে ফিরিয়েও আনল। তার সমস্যাটা নিজের প্রেম নয়, বাবার প্রেম। তার বাবা তার চেয়ে বছর তিনেকের বড় একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে এবং তাকে মা ডাকতে রুমানাকে বাধ্য করেছে। এটা মেনে নিতে পারছিল না বলেই স্যাভলনকে মুক্তির ওষুধ মনে করেছিল।

হোস্টেল সুপারের বাড়তি কোনো বেতন নেই, লাভ একটাই নিচতলায় সিঁড়ির পাশের দুটো রুম পাওয়া যায়, একটাতে এ্যাটাচড বাথরুম আছে। এটাই বেডরুম আর পাশেরটাতে পার্টিশন দেয়া, পেছনে কিচেন, সামনে পুরনো একসেট সোফা, ছাত্রীদের অভিভাবকদের জন্য। পাশের রুমটি কখনো খোলা দেখিনি। হোস্টেলের রান্না থেকেই সুপারের খাবার আসে, কেউ টাকা দেন, কেউ দেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App