×

জাতীয়

রাতারাতি দাম বেড়ে দ্বিগুণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১২ এএম

রাতারাতি দাম বেড়ে দ্বিগুণ

পেঁয়াজের আড়ত।

ভারতের ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলেন কারবারিরা দাম উঠেছে ১২০ টাকায় মজুতের অপব্যবহার
বন্যার কারণে চলতি মাসের শুরুতে ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা। এই খবর বাংলাদেশে পৌঁছার পরপরই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় কেজিপ্রতি ২০ টাকা পর্যন্ত। গত সোমবার ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর দেশের বাজারে রাতারাতি পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ আড়তদার ও পাইকারদের গোডাউনে মজুত আছে ভারত/দেশীয় বাজার থেকে অনেক কম দামে সংগ্রহ করা লাখ লাখ বস্তা পেঁয়াজ। অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার অপেক্ষাতেই ছিলেন তারা। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় দেশে পেঁয়াজ নিয়ে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজের কেজি ছাড়িয়ে যায় ৩০০ টাকা। এবারো একই আশঙ্কায় বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ক্রেতারা। আর তার সুযোগ নিচ্ছেন মুনাফাখোররা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে পেঁয়াজের উৎপাদনও প্রতি বছর প্রায় ৫-৬ শতাংশ বাড়ে। বর্তমানে দেশে মোট পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ২৫ লাখ টন। বার্ষিক গড় উৎপাদন ২০ লাখ টনের কম। তাই চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৬-৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়ে। আগস্টে দেশীয় মজুত শেষ হওয়ার কারণে আমদানি চাহিদা বেড়ে যায় অনেকগুণ। এর প্রভাব পড়ে বাজারে। একই কারণে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা আসা মাত্রই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে জরুরি এই পণ্যের দাম। এর সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরবরাহ স্বাভাবিক করতে না পারলে বাজারে গত বারের মতো অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর পাইকারি আড়ত শ্যামপুর ও কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা আর আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় দাম। দুপুরের পর প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকা পর্যন্ত। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮০-১০০ টাকা। অথচ সোমবারও দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা আর আমদানি করা পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এক রাতের ব্যবধানে দেশীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫৫ টাকা। ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই দাম দ্বিগুণ!

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, রাতারাতি দাম বাড়াটা খুবই অযৌক্তিক। যারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। একই সঙ্গে গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিকল্প উৎস থেকে আমদানির পরামর্শও দেন তিনি।

আমদানিকারকরা বলছেন, ভারত পেয়াঁজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় এর প্রভাব দেশের বাজারে পড়ছে। তবে দাম এত বাড়ার কথা না। রাজধানীর শ্যামবাজারের আমদানিকারক হাজী হাফিজ মিয়া ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের পেঁয়াজ আমদানি মূলত ভারতনির্ভর। যার কারণে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় এর কিছুটা প্রভাব বাজারে পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এতটা বেশি দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই আমদানিকারক বলেন, শ্যামবাজারে কবে, আর কত দামে পেঁয়াজের চালান এসেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তা খতিয়ে দেখা উচিত। এতেই বের হয়ে আসবে কারা এর সঙ্গে জড়িত।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের বৃহৎ পেঁয়াজের আড়ত খাতুনগঞ্জের শহিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস ভোরের কাগজকে বলেন, পেঁয়াজের দাম যে হারে বেড়েছে, তার পেছনে কোনো যুক্তি বা ব্যাখ্যা খাটে না। তিনি আরো বলেন, ভারত যেহেতু রপ্তানি বন্ধ করেছে, আমাদের বিকল্প চিন্তা করা উচিত। কিছু ব্যবসায়ী আগেই অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন। আমার বিশ্বাস, এই সংকট বেশি স্থায়ী হবে না।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় গত বছরের মতো এবারো দাম বাড়ার আশঙ্কায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পেঁয়াজ কিনছে। ফলে কেজিতে দাম বেড়ে গেছে ৪০-৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার কারণেই খুচরা বাজারেও দাম বাড়ছে বলে দাবি তাদের।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পেঁয়াজের দামের পাগলাঘোড়া ঠেকাতে ইতোমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, দেশের আট বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জেলা প্রশাসককে বাজার মনিটরিং জোরদার করার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ী ও নাটোরের জেলা প্রশাসককে পেঁয়াজের উৎপাদন, মজুত, সরবরাহ এবং মূল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কথা বলা হয়েছে।

পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিকারকদের এলসি খোলাসহ সার্বিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজ স্থলবন্দর থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ছাড় করার পাশাপাশি আপাতত ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে। এর পাশাপাশি পেঁয়াজের উৎপাদন, মজুত ও মূল্য পরিস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৩ যুগ্ম-সচিবকে পাবনা, নাটোর, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে পাঠানো হয়েছে।

স্থল ও নদী বন্দরে পেঁয়াজের আমদানি পরিস্থিতি, কন্টেইনার জট ও কৃত্রিম সংকট আছে কিনা- তা দেখে স্ব স্ব কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া জরুরিভিত্তিতে তুরস্ক থেকে ১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ আমদানি কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। অন্যদিকে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের জন্য গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ টাকা দরে সারাদেশে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, আগস্টে দেশীয় পেঁয়াজের মজুত শেষ হয়ে যায়। ফলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পুরোটা আমদানিনির্ভর হয়ে যায় পেঁয়াজের বাজার। তাছাড়া পচনশীল ও জরুরি পণ্য হচ্ছে পেঁয়াজ। যার কারণে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে দাম বেড়ে যায়। এই গবেষকের মতে, গত বারের মতো এবারো ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করে বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। নয়তো গত বছরের মতোই অস্থিরতা তৈরি হতে পারে পেঁয়াজের বাজারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App