×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা গ্রামের নাম মুছে দেয়া কীসের আলামত?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:১৪ পিএম

‘মানচিত্র থেকে ক্রমান্বয়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গ্রামের নাম একের পর এক মুছে দিচ্ছে’ এ রকম একটি সংবাদ সম্প্রতি রয়টার্সে প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী নতুন করে মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বেশ আলোচনা/সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গা গ্রামের নাম মুছে দেয়া নিয়ে প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একটা ব্যাপক কাভারেজ দিয়েছে। বিশেষ করে নাফ নদের মিয়ানমারের পাড় থেকে প্রায় ৫-৬ কিলোমিটারের মধ্যে খান-খেয়া নামে রোহিঙ্গাদের একটি গ্রাম ছিল ২০১৭ সালের আগে। কিন্তু জাতিসংঘের ‘ম্যাপিং ইউনিট’ মিয়ানমারের মানচিত্র পুনরুৎপাদন করতে গিয়ে দেখে যে, খান-খেয়া নামক সে গ্রামটি সেখান থেকে মুছে দেয়া হয়েছে। এখানে বলে রাখা জরুরি যে, জাতিসংঘের একটা ‘ম্যাপিং ইউনিট’ আছে যারা বিভিন্ন দেশের সরকার কর্তৃক তৈরি করা মানচিত্রকে পুনরুৎপাদন করে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার (ইউনিসেফ, ইউএনএইচসিআর, ইউএনডিপি প্রভৃতি) কাজে ব্যবহার করে। নতুন মানচিত্রে খান-খেয়া গ্রামটিকে মংডু টাউনশিপের বর্ধিত অংশ বলে দেখানো হয়েছে, যেখানে বড় বড় দালান দেখা যাচ্ছে। সামরিক-বেসামরিক নানা স্থাপনা দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই মিয়ানমারের এ ধরনের সুপরিকল্পিত কার্যক্রমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথকে আরো জটিল করে তুলবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এখন মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গা গ্রামের নাম মুছে দেয়া কীসের আলামত? এখানে উল্লেখ্য, খান-খেয়া গ্রামটির নাম মুছে দেয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় হৈচৈ পড়ে গেলেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামের নাম মুছে দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয় কিংবা এটা একেবারেই নতুন কোনো ঘটনা নয়। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মিনিস্ট্রি অব হোম-অ্যাফেয়ার্সের যে মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের মিলিটারির নিয়ন্ত্রণে, একটি অঙ্গ ‘জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্ট’ রাখাইনের ১৬টি গ্রাম পুনর্গঠনের কার্যক্রম হাতে নেয়। সে ১৬ গ্রামের মধ্যে ১০টি গ্রামের নাম মুছে দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৫টি গ্রাম ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখের পর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাকি ৫টি গ্রাম ২০১৭ সালের আগে থেকেই ধ্বংস করা হয়েছিল। সুতরাং রোহিঙ্গাদের একটি মাত্র গ্রাম ‘খান-খেয়া’র নাম মুছে দেয়া হয়েছে, বিষয়টি একেবারেই তা নয়। বরঞ্চ, মিয়ানমার সুকৌশলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নাম ও নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় পলিসির অংশ হিসেবে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে নির্মম নির্যাতন, নিষ্ঠুর অত্যাচার, নির্বিচার ধর্ষণ এবং জঘন্য জেনোসাইড সংঘটন করে, তার মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া। কত গ্রাম যে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচে’র রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৪০০ গ্রামকে পুরোপুরি জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছিল আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে প্রথম দুই মাসের মধ্যে। জাতিসংঘ গঠিত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, যা ২০১৮ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়, প্রায় ৩৯২টি গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের আগস্টের পর। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এবং বিভিন্ন মিডিয়া কর্তৃক ধারণকৃত বিভিন্ন ড্রোন ফুটেজ অনুযায়ী প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই শুধু একটি গ্রাম নয়, বরঞ্চ এ ৫০০ গ্রামের মধ্যে কয়টি গ্রাম যে মানচিত্রে আছে সেটা নিয়ে নতুন করে গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। এছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জেনোসাইড থেকে প্রাণে বাঁচতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা যখন বাংলাদেশে জান নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে আসে, তখন তাদের ফেলে আসা বসত-ভিটাগুলো রীতিমতো জনশূন্য নরকে পরিণত হয়। ধ্বংসস্ত‚পের পাহাড়ে পরিণত হয়। তখনই বুলডোজার নিয়ে এসব গ্রামে জেনাসাইডের আলামত নষ্ট করার নানা তথ্য এবং সংবাদ আমরা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখেছি। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল কিন্তু মিয়ানমার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেনি। নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে গেছে এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের চিহ্ন যতটুকু সম্ভব মুছে দেয়ার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলার বিচারাধীন অবস্থায় মিয়ানমারকে কয়েকটি প্রারম্ভিক ব্যবস্থাপনার (প্রভিশনাল মেজর) নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল, ২০১৭ সালে সংঘটিত গাম্বিয়ার কর্তৃক দাবিকৃত জেনোসাইডের আলামত যেন নষ্ট না করা হয়। এবং জেনোসাইডের আলামত যেন সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু মিয়ানমার খান-খেয়াসহ ৫টি গ্রামের নাম মুছে দেয়ার মধ্য দিয়ে মূলত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের যাকে ‘ওয়ার্ল্ড কোর্ট’ বলা হয়, আদেশকেও অমান্য করেছে। এর ভেতর দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাষ্ট্রীয় পলিসির একটি ধারণা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই শিরোনাম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে মোটাদাগে দুটি। এক. মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামের নাম মুছে দেয়ার অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে আর ফিরে যেতে না পারে, তার একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা। কেননা ২০১৭ সালে যে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে যারা সেই মুছে ফেলা গ্রামগুলো থেকে এসেছে, তাদের তালিকা যখন বাংলাদেশ মিয়ানমারকে হস্তান্তর করবে, তখন মিয়ানমার দাবি করবে যে ‘এসব মানুষের কোনো ঠিকানা মিয়ানমারের রাখাইনে নেই। এরা যেসব গ্রাম থেকে এসেছে, সেসব গ্রামেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। এরা রাখাইনের কখনই ছিল না। অর্থাৎ তাদের ভেরিফিকেশন করা সম্ভব হয়নি।’ হয়তো সে কারণেই বাংলাদেশ যখন ৬ লাখ রোহিঙ্গার নাম ও ঠিকানাসহ তালিকা মিয়ানমারকে দেয়, তখন মিয়ানমার মাত্র ৩০ হাজার রোহিঙ্গার ভেরিফিকেশন করতে পারে। এটা হচ্ছে মিয়ানমারের ট্রিক্স, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ গ্রামে এবং নিজের বসত-ভিটায় ফিরে যেতে না পারে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাম ও ঠিকানা যেন ২০১৭ সালের আগের মানচিত্রের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই হয়, সে বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করতে হবে। দুই. রোহিঙ্গাদের গ্রামের নাম মুছে সেখানে সামরিক-বেসামরিক স্থাপন তৈরি করা মূলত মিয়ানমারের আরেকটি রাষ্ট্রীয় পলিসি, যাতে করে সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দেয়া যায়। যেহেতু বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই প্রত্যাবাসনকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে সামনে রেখে সব ধরনের দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, সেহেতু অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নাগরিক অধিকার ও জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নের পাশাপাশি রোহিঙ্গা মিয়ানমারে কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, তাদের ফেলে আসা বসত-ভিটা তাদের ফেরত দেয়া হবে কিনা প্রভৃতি অনেক প্রশ্নের উত্তর রোহিঙ্গাদের বসত-ভিটা বুলডোজার দিয়ে পিষে মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামের নাম মুছে ফেলার ভেতর দিয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারের ফিরতে চাইবে না। এর মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে সেল করবে যে, আমরা তো রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চেয়েছি, কিন্তু রোহিঙ্গা নিজেরাই আসছে না। এট হচ্ছে মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামের নাম মুছে দেয়ার আরেকটি অন্যতম ট্রিক্স। পরিশেষে বলব, মিয়ানমার যত কিছুই করুক রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে, কেননা তারাই এ সমস্যা এবং সংকটের স্রষ্টা। যেহেতু রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় এবং ইজ্জতের সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান নিহিত সেহেতু রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে ফিরে যায়, তার ব্যবস্থা মিয়ানমারকেই করতে হবে। যদি মিয়ানমার স্বেচ্ছায় সেটা না করে, তবে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। এবং এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় ভ‚মিকা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। সমানুপাতিক চাপ বা অধিকতর চাপ মিয়ানমারের ওপরও প্রয়োগ করতে হবে। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App