×

মুক্তচিন্তা

বিশ্ববিদ্যালয় ও আমাদের মানসিকতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৪৭ পিএম

বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের চিত্র যদি দেখি তাহলে প্রায় সব স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ফুটে উঠবে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বাজেট প্রণয়ন করা হলেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ কমেছে আগের তুলনায়। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গবেষণা খাতে মোট বরাদ্দ করা হয়েছে ৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮১০ কোটি ৪২ লাখ বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার টাকা, যা বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এরকম প্রতিনিয়ত বাজেটে বরাদ্দ কমতে থাকলে ভালো মানের গবেষক তৈরি হবে না। গবেষণায় বরাদ্দ কম নিয়ে অভিযোগ থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণা খাতের বরাদ্দ শেষ করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছর বাজেটে গবেষণা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে গবেষণা খাতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৮ কোটি ৭২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ গবেষণা-বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যয় করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে দুটি ভিন্ন পরিসংখ্যান সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমটিতে অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও দ্বিতীয়টিতে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহার না হওয়া প্রসঙ্গ রয়েছে। দ্বিতীয় পরিসংখ্যানকে একমাত্র সূত্র হিসেবে নিলে ভাবতে হবে যা বরাদ্দ দেয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি, তাই গবেষণা খাতে বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমছে! ঘটনা মোটেও সে রকম নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চৌর্যবৃত্তির খবর গণমাধ্যমে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রখ্যাত দার্শনিক মিশেল ফুকোর প্রবন্ধ থেকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে প্রবন্ধ প্রকাশ করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।  এ ঘটনা দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক। এর আগেও এ রকম ঘটনার নজির রয়েছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, খোঁজ নিলে এরকম অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেই পাওয়া যাবে। এই চৌর্যবৃত্তির ঘটনা থেকেই দেখতে পারি একজন শিক্ষকেরই গবেষণা নিয়ে আগ্রহ নেই! তাহলে তার থেকে আরেকজন শিক্ষার্থী কীভাবে গবেষণার প্রতি আগ্রহী হবে! এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন এসে যায় তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই কি এমন? শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা না গেলেও বলা যায় কিছুসংখ্যক শিক্ষক চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। গবেষণা যে একেবারেই হচ্ছে না সে রকম নয়, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রতি বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে জায়গা করতে পারে না তার প্রধান কারণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রিসার্চ পেপার না থাকা। গবেষণা চুরি করা, গবেষণায় অনীহার ঘটনা শিক্ষকদের কাছে আশা করা যায় না। তবুও প্রতি বছর এরকম ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে কত ভালো রেজাল্ট বা কী পরিমাণ গবেষণাধর্মী কাজ করেছে তার থেকেও বেশি জোর দেয়া হয় রাজনৈতিক নেতার সুপারিশের ওপর। ফলে যার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই সে রকম মানুষরা জীবিকার তাগিদে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয় এবং তাকে দেখে আরো শিক্ষার্থী মনে মনে ধারণা করে গবেষণা ছাড়াই যদি শিক্ষক হওয়া যায় তাহলে কেন এই অযথা পরিশ্রম! বাংলাদেশে হরহামেশাই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জাতীয় সংসদে বিল পাস হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল পাস হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান বেড়েছে কিনা সন্দিহান। প্রায় সব স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়। রাজনৈতিক কর্তাদের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটে থাকে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি গড়ে উঠছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। দিনে দিনে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস নেই, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এতে করে প্রতি বছর চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যাই বাড়ছে, দক্ষ মানবসম্পদ আর বাড়ছে না! শিক্ষা যেমন জাতির মেরুদণ্ড তেমনি এই মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে গবেষণাহীন একটি শিক্ষিত প্রজন্মই যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদকে একটি চাকরির নিশ্চয়তা না ভেবে, গৎ বাঁধা জীবনের বাইরে চিন্তা করতে হবে। নতুন একটি প্রজন্মকে তৈরি করতে হলে গবেষণা অত্যাবশ্যক। গবেষক তৈরি করতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ছাড়াও অন্যান্য কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকতে হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে তৎপর হতে হবে। এবং এক্ষুনি উপযুক্ত সময় আমাদের মন-মানসিকতায় ও আমাদের শিক্ষা কাঠামোয় পরিবর্তন আনার জন্য। শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App