×

মুক্তচিন্তা

বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫২ পিএম

বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত
সরকার গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে, যা আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। উল্লেখ্য, কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অর্থনীতির সব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা যেহেতু একটি সেবা খাত, এর ক্ষতি নিরূপণ করা এত সহজ হবে না অন্যান্য খাতের মতো। কিন্তু ইউনেস্কো বলেছে নভেল করোনার কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা আশা করছে এবং এছাড়া ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও এই ক্ষতির হুমকিতে রয়েছে। প্রথমে আসা যাক শিক্ষার্থীদের বিষয় নিয়ে যেখানে বাংলাদেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী ২ কোটি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী ৪ লাখ, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী ১ কোটি, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ৪০ লাখ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কলেজের শিক্ষার্থী ২৮ লাখ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৩৮ লাখ ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৫ লাখ। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সব স্কুলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (ইইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা বাতিল করেছে সত্যি কিন্তু শিক্ষার্থীদের নলেজের ভাণ্ডার কতটুকু পূরণ হলো তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে বিশেষত যেগুলো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং স্কুল বন্ধ থাকায় টিউশন ফি দেয়া থেকে তারা বিরত রয়েছে যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে চাপ অব্যাহত রেখেছে। আজ যারা প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে তাদের ভেতর থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা ১০-১৫ বছর পর উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের ভিত যদি দুর্বল হয় তবে জাতির ভিত্তি মজবুত হবে কী করে। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো সার্বিক আয়োজনটি হয়ে গেছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক, নলেজভিত্তিক নয় এবং এই প্রতিযোগিতায় ভালো গ্রেড পাওয়াই মূল লক্ষ্য, যার জন্য যা কিছু করা দরকার সেটাই চলছে বৈধ কিংবা অবৈধ পথেই হোক না কেন। ফলে শিক্ষার্থীর তুলনায় অভিভাবকদের বেশি তৎপর হতে দেখা যায় শিক্ষার্থীর মতামতকে উপেক্ষা করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য সত্যি কিন্তু সেটি কীভাবে হবে সেই সম্পর্কে প্রথম গবেষণাটি করেছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ জে হাটগ। তিনি সারা ভারতবর্ষ ঘুরে যে গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছিলেন তা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এই গবেষণার প্রায়োগিক ফলাফল নিয়ে কেউ কিছু করতে পেরেছিলেন কিনা তা আর জানা যায়নি। জর্জ বার্নাডশ তার ম্যান এন্ড সুপারম্যান নাটকে একটি চরিত্রের মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্ম সুরে বলেছিলেন, যে পারে সে করে আর যে পারে না সে হয় শিক্ষক। শিক্ষকদের সক্ষমতা নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য আমাদের সমাজে নতুন নয়। তারপরও সমাজের নানা পরিবর্তন সত্তে¡ও শিক্ষকের একটি ভ‚মিকা সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যায়নি। শিক্ষক এখনো মানুষ গড়ার কারিগর এবং বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রধান দায়িত্ব শিক্ষকদের, যা সমাজের আরো দশটি পেশা থেকে ভিন্ন যদিও সমাজ সেটি উপলব্ধি করতে পারছে না, যার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। এখন আসা যাক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে পাবলিক সেন্টিমেন্ট কি এবং এর সঙ্গে সরকারের অবস্থান কী? বছরের শেষ প্রান্তে এসে শিক্ষায় সেশনজট কীভাবে নিরসন হবে? এও শোনা যাচ্ছে ৪ অক্টোবর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ঠিক হবে কিনা? শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে পরবর্তী শ্রেণিতে অটোপ্রমোশন দেয়া ঠিক হবে কিনা? এ ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া মিশ্র, যা দুই মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন একটি বছর ছেলেমেয়েরা না পড়লে মূর্খ হবে না, কিন্তু করোনায় সংক্রামিত হলে বহু মায়ের বুক খালি হবে। এই উক্তি থেকে পরিষ্কার যে সরকার অন্তত এ বছরটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নয়। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন অটোপ্রমোশনের কথা। তাহলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যেহেতু একটি বৈশ্বিক সমস্যা তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের শিক্ষা সংকট নিয়ে এগোচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয়। অস্ট্রেলিয়া প্রথমদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আবার প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জার্মানির একটি রাজ্যে আগস্টের প্রথমদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর পাবলিকের ঘোর আপত্তির কারণে আবার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয় সরকার। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিধায় সে দেশের সরকার বর্তমান বছরে প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে আগস্টে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নিলেও প্রেসিডেন্টের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. স্কট এটলাসের তীব্র আপত্তির মুখে রাজ্য সরকার এটি আর বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিটাকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে এই কারণে যে প্রতিদিনই দেশের মিডিয়াগুলো বৈশ্বিক বনাম বাংলাদেশের সংক্রমণ, সুস্থতা ও মৃত্যুর হার প্রচার করে চলছে, যার সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ইমেজ জড়িত রয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, উদ্যোক্তা এই চারটি স্টেকহোল্ডার যারা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত তাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে আন্দোলনের পথ বেছে নেবে কি? এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থী তাদের স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা বিলম্বের কারণে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, যা কাম্য নয়। এখন সরকারের সামনে কতগুলো বিকল্প সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। যেমন অতি দ্রুত বেসরকারি-সরকারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ছাত্র-শিক্ষক সবাই যার যার ক্লাসে উপস্থিত থাকবে। যদি অবস্থার সত্যি সত্যি উন্নতি হয় ভালো আর যদি না হয় তবে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে; বিগত আট মাসে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উদ্যোক্তা ও শিক্ষকরা যে আর্থিক সংকটে পড়েছেন তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করতে পারে সংকটকালীন সময়ের জন্য যেমনটি সরকার অন্যান্য খাতের জন্য করেছে; উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে এই কারণে যে শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, এটি একটি সেবা খাত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ধারাটি লঙ্ঘনের আলামত পাওয়া যাচ্ছে, যা সবাই জানেন। দুর্যোগ কখন আসবে কেউ জানে না, যার জন্য বার্ষিক লভ্যাংশ থেকে আপদকালীন ফান্ড গঠন করা সময়ের দাবি। করোনাকালের শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর নিয়ে দেশের মধ্যে কেউ ভাবছে তা বোঝা দুষ্কর। কারণ সরকার প্রথম থেকেই একলা চলা নীতিতে চলছে, যদিও সেটি একটি জাতীয় সমস্যা। সরকার এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে; করোনা মোকাবিলায় কেরালা মডেল থেকে ধারণা নেয়া যেতে পারে, বিশেষত কীভাবে তারা তাদের শিক্ষা সংকট করোনাকালে করেছে। সবশেষে বলা যায় কোভিড-১৯ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হবে তা এই মুহূর্তে বলা যায় না। অর্থনীতিসহ জীবন-জীবিকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের উদ্যোগের কোনো ঘাটতি নেই। এই পর্যায়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক, নীতিনির্ধারকরা সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেবেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যে আর্থিক দুর্বলতা করোনার কারণে সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে ক্যাম্পাস মুখরিত হোক সেই প্রত্যাশা রইল। ড. মিহির কুমার রায়, ডিন ও অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি। mihir.city@gmail

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App