×

জাতীয়

দেশের নৃত্যশিল্পে নারী পাচারকারীদের থাবা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:১৪ এএম

দেশের নৃত্যশিল্পে নারী  পাচারকারীদের থাবা

প্রতীকী ছবি

  • দুবাই বসে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে আজমের ভাই নাজিম ও এরশাদ
  • গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়েরা মূল টার্গেট, দেশে সক্রিয় অর্ধশত দালাল
নারী পাচারকারীদের থাবা পড়েছে দেশের নৃত্যশিল্পে। যতই দিন যাচ্ছে একের পর এক উঠে আসছে নতুন নতুন নাম। ভারী হচ্ছে গ্রেপ্তারের পাল্লা। ইতোমধ্যে মূলহোতা আজমসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশব্যাপী চক্রটির শক্ত নেটওয়ার্ক। নৃত্যশিল্প নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরাও। সর্বশেষ গত শুক্রবার দুবাইয়ে নারী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ রাজধানীর নিকেতনের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। ইভান শাহরিয়ারকে গতকাল শনিবার কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনা না গেলে নৃত্যশিল্পীর আড়ালে নারীপাচার থামবে না।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দুবাই পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে নারী পাচারকারী চক্রের মূলহোতা আজমকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনো সক্রিয় রয়েছে চক্রটি। এদের টার্গেট মূলত নৃত্যকেন্দ্রিক। করোনা মহামারির কারণে এখন কিছুটা স্থবির রয়েছে তাদের কার্যক্রম। তবে সিন্ডিকেটের দেশীয় দালালরা বসে নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার নারী পাচার করার লক্ষ্যে কাজ করছে তারা। আর এ চক্রের বর্তমান নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলহোতা আজমের ভাই নাজিম ও এরশাদ। ড্যান্সক্লাবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নারী সংগ্রহের চেষ্টা করছে তারা। আর এ কাজে সহযোগিতা করছে দেশীয় অর্ধশত দালাল। যারা বেশ কয়েকটি জেলায় জাল বিছিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসিম, জসিম, সজিব, নিজাম, স্বপন ও তানভীর। এছাড়াও কয়েকজন নৃত্যসংগঠক ও শিল্পী এবং ছোটখাটো ক্লাবের কর্ণধাররা এই নেটওয়ার্কের অন্যতম সদস্য।

মূলহোতা আজমকে গ্রেপ্তারের পর সিআইডি জানিয়েছিল, আজম খানের নামে দুবাইতে ৪ তারকাযুক্ত ৩টি ও ৩ তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেল রয়েছে। হোটেলগুলো হচ্ছে- ফরচুন পার্ল হোটেল এন্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। পাচারকৃত শত শত নারীদের এসব হোটেলে রাখা হতো। বর্তমানে আজমের দুই ভাই গাঁ ঢাকা দিয়ে পাচারের কৌশল পাল্টে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ৪টি ধাপে পাচার করা হয় নৃত্যশিল্পীদের। প্রথম ধাপে, সুন্দরী নৃত্যশিল্পীকে টার্গেট করে দুবাইফেরত নারীদের মিথ্যা আর্থিক সমৃদ্ধির গল্প শুনিয়ে প্রলোভন দেখায় দেশীয় এজেন্ট বা দালালরা। যদি ওই শিল্পী রাজি হয়ে যান তাহলে ছবি তুলে পাঠানো হয় দুবাইয়ে। সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল মিললে দ্বিতীয় ধাপে দালালরা তাদের পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে ট্র্যাভেল এজেন্ট। তাদের কাছে ভিজিটিং ভিসা পাঠিয়ে দেয় দুবাইয়ের ড্যান্স বারের মালিকরা। পরবর্তী ধাপে আছে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু অসাধু ব্যক্তি। একজন নারী ইমিগ্রেশন পেরিয়ে দুবাই যাবার জন্য ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় তাদের।

এভাবে একজনকে দুবাই পাঠাতে ২ লাখ টাকার বেশি খরচ হলেও পুরোটাই বহন করে ড্যান্স বারের মালিকরা। এরপরই ওই নৃত্যশিল্পীদের পতিতাবৃত্তি করাতে বাধ্য করা হয়। যে শিল্পীদের চাহিদা বেশি থাকে তাদের ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে বছরের পর বছর রেখে দেয় ড্যান্স বারের মালিকরা। আর যাদের দিয়ে বেশি লাভ করতে পারে না তাদের ৩ মাস পরেই দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

প্রলোভনে পড়ে দুবাই গিয়ে ফেরত আসা নৃত্যশিল্পী লাবণী আক্তার (ছদ্মনাম) জানান, ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর পেটের দায়ে রাজধানীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ করতেন তিনি। নাচ করার সূত্র ধরেই এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হয় দুবাইয়ের একটি ড্যান্স বারের এজেন্টের। ওই এজেন্ট তার নাচের প্রশংসা করে দুবাইয়ে মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি প্রলোভন দেখান। নিজের কাছে কোনো টাকা না থাকায় প্রথমে রাজি হননি তিনি। পরে ওই এজেন্ট তাকে পাসপোর্ট করাসহ সব খরচ দিয়ে দুবাই নেয়ার কথা বলেন। এতে সহজেই রাজি হয়ে যান লাবণী আক্তার। এর কিছুদিন পর অবিশ্বাস্যভাবে পাসপোর্ট ও দুবাই যাওয়ার ভিসা হাতে পান। সঙ্গে দেয়া হয় ৩০ হাজার টাকাও।

পরে দুবাই পা রেখেই এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন লাবণী। ঠাঁই হয় সিটি টাওয়ার হোটেলের একটি জানালাবিহীন কক্ষে। ওই হোটেলে সে ছাড়া আরো প্রায় ২০ নারী ছিলেন। প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত তাদের আরবি, হিন্দি ও ইংরেজি গানের সঙ্গে নাচতে হতো। অতিথিরা চাইলে তাদের সঙ্গে রাত কাটাতে হতো। বিনিময়ে অর্জিত অর্থ তুলে দিতে হতো হোটেল সংশ্লিষ্টদের। এতে কেউ রাজি না হলে নেমে আসত অমানুষিক নির্যাতন।

শুধু লাবণী আক্তার নয়, এ ধরনের প্রতারণের শিকার হয়ে দুবাইতে নির্বিসহ জীবন কাটাচ্ছেন পাচার হওয়া শত শত নৃত্যশিল্পী। অজানা আতঙ্কে হোটেলগুলোর জানালাবিহীন ৪ দেয়ালে নীরবে চোখের জল ফেলছেন তারা। দেশের নৃত্যশিল্পে আজমসহ আরো বেশ কয়েকটি চক্রের এ ধরনের কাজের জন্য ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে উদীয়মান নৃত্যশিল্পী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন নৃত্যশিল্পী বলেন, আমরা যে গুরুজিদের ওপর ভরসা করে নাচ শিখব, নিজেদের পেশা হিসেবে এটিকে বেছে নিব, তাদের মাধ্যমে পাচার হওয়ার খবর আমাদের বিস্মিত করেছে। নৃত্যশিল্পী পাচারের খবরে নিজের সন্তানকে নাচ শিখাতে দুবার ভাবতে হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন অনেক অভিভাবক। এতে দেশের নৃত্যশিল্পে প্রভাব পড়তে পারে বলেও মত সংশ্লিষ্টদের।

তবে এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্যাঞ্চলের সভাপতি শিবলী মোহাম্মদ ভোরের কাগজকে বলেন, এ ধরনের গর্হিত কাজ থেকে রক্ষা পেতে প্রথমে সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। নিজের সন্তানকে কার তত্ত্বাবধানে নাচ শিখতে দিচ্ছেন, তার সন্তানের গতিবিধিতে পরিবর্তন এসেছে কিনা সব কিছু খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু এ চক্রগুলো গরিব পরিবারগুলোকে প্রলোভন দেখাচ্ছে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ওই পরিবারকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি পাচার রোধে সরকারকেও আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নৃত্যশিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মিনু বিল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, নৃত্যশিল্পীদের আমরা সন্তানের মতো কেয়ার করে থাকি। কোনো কুচক্রিমহল এখানে প্রভাব ফেলতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা ভোরের কাগজকে বলেন, এ চক্রের মূল টার্গেট গরিব ঘরের মেয়েরা। দুবাইতে হোটেলে ৫০ হাজার টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ভিজিটিং ভিসায় সেখানে নেয়া হয়। এরপরই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। একপর্যায়ে পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়। এ চক্রের মূলহোতা আজমসহ ৬ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের চক্রের আরো বেশ কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশ ও দুবাইয়ে সক্রিয় রয়েছে। আমরা তাদের গ্রেপ্তারের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। শুধু আজম গ্রুপ নয় এ ধরনের অন্য চক্রের খোঁজ পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

প্রসঙ্গত, পাচারের শিকার নারীদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে গত ২ জুলাই সিআইডির পক্ষ থেকে লালবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মাসেই মাসে গ্রেপ্তার করা হয় মূলহোতা আজমসহ তার দুই সহযোগী ময়না ও মো. আল আমিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ডকে। পরে গ্রেপ্তার করা হয় আজমের এদেশীয় প্রতিনিধি নির্মল ড্যান্স একাডেমির নির্মল সরকার ও আজমের ভাই নাজিমের বন্ধু মো. ইয়াছিনকে। ইতোমধ্যে আজমসহ তার ২ সহযোগী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App