×

জাতীয়

চুরির গল্প থেকে এবার প্রতিশোধের কাহিনী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:০৬ এএম

চুরির গল্প থেকে এবার প্রতিশোধের কাহিনী

রবিউল

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম হত্যাচেষ্টা মামলার মোটিভ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে নিত্যনতুন কাহিনী তুলে ধরছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দেয়ার পাশাপাশি সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। চুরির দায়ে ইউএনও অফিস থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মালি রবিউল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল শনিবার দিনাজপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মুখে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, বরখাস্ত করার প্রতিশোধ নিতেই ইউএনওর ওপর হামলা চালান রবিউল। প্রাথমিকভাবে পুলিশের কাছে হামলার দায় স্বীকার করেছেন তিনি। তার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বেশকিছু আলামত উদ্ধার করেছি। তার বক্তব্য ও জব্দ করা সিসিটিভি ফুটেজের মিল পাওয়া গেছে।

এর আগে, গত ৪ সেপ্টেম্বর স্থানীয় যুবলীগ নেতা আসাদুল হকসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১৩ অধিনায়ক রেজা আহাম্মেদ ফেরদৌস বলেন, চুরির উদ্দেশ্যেই ইউএনওর বাসায় যায় ওই ৩ জন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসাদুল হক ইউএনওর ওপর হামলা করে তাকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করেছেন। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে ঘোড়াঘাট এলাকা থেকে নবিরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সবাই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। পরে তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী তল্লাশি চালিয়ে ঘটনাস্থলের সিসি টিভির ফুটেজে প্রাপ্ত একজন আসামির চুন মাখা লাল টি-শার্ট উদ্ধার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার মো. রবিউল ইসলামকে (৩৬) গ্রেপ্তার করা হয়। সে বিরল উপজেলার ধামইরহাট ভীমপুর গ্রামের খতিব উদ্দিন আহম্মেদের পুত্র। গতকাল বিকালে দিনাজপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইসমাইল হোসেনের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশ পরিদর্শক আবু ইমাম জাফর। শুনানি শেষে বিচারক ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গতকাল সন্ধ্যায় আবু ইমাম জাফর ভোরের কাগজকে বলেন, রবিউলকে ডিবির হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত হাতুড়ি দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়া থেকে কেনা হয়েছিল। গত শুক্রবার মধ্যরাতে ইউএনও ওয়াহিদার সরকারি বাস ভবনের সম্মুখের পুকুর থেকে ওই হাতুড়ি, চাবির থোকা, একটি কাঠের মই ও অন্যান্য উপকরণ উদ্ধার করেছে ডিবি পুলিশ। তাছাড়া ইউএনওর বাসভবনে লাগানো সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যে ব্যক্তিকে দেখা যায়, সেই ব্যক্তির দৈহিক গড়ন ও হাঁটাচলার সঙ্গে রবিউলের অনেক মিল রয়েছে।

এদিকে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪ মাস আগে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ব্যাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি হয়। সেই সময় উপজেলা কার্যালয়ের মালি রবিউলকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে তিনি তখন চুরির কথা স্বীকার করেননি। পরবর্তী সময়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রবিউলকেই চোর হিসেবে শনাক্ত করা হয়। শাস্তি হিসেবে বিভাগীয় মামলা দায়েরের পাশাপাশি সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে। সূত্র আরো জানায়, এ ঘটনার প্রায় ৮ মাস আগে জেলা প্রশাসকের বাংলোতে ফরাশ পদে কাজ করতেন রবিউল। সেখানে তার কাজ সন্তোষজনক না হওয়ায় ঘোড়াঘাট উপজেলায় বদলি করা হয়।

অন্যদিকে এই মামলায় আদালতের আদেশে গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দিনের রিমান্ডে থাকা আসাদুল হক এবং গত শুক্রবার গ্রেপ্তার হওয়া আসামি সদর উপজেলা পরজপুর গ্রামের সুলতান আহম্মেদের পুত্র নাহিদুল হোসেন পলাশকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পলাশ ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদের নৈশ্যপ্রহরী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে গত শুক্রবার অপর ২ আসামি সান্টু কুমার দাস ও নবীরুল ইসলামকে ৭ দিন রিমান্ড শেষে জেল হাজতে পাঠানো হয়।

একই ঘটনায় দুটি বাহিনীর তদন্তে পৃথক পৃথক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা এবং ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজ শিক্ষক ভোরের কাগজকে বলেন, ঘোড়াঘাটের ঘটনায় মনে হচ্ছে আরেক ‘জজ মিয়া’ তৈরি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। না হলে একই ঘটনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ও ভিন্নজনকে জড়িয়ে কিভাবে স্বীকারোক্তি আদায় সম্ভব? তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এখানে ‘জজ মিয়া’ আসলে কে? আসাদুল নাকি রবিউল? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পাওয়ার পাশাপাশি আমরা সাধারণ জনগণ প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি চাই।

গতকালের প্রেস ব্রিফিংয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, এ ঘটনায় আসাদুল জড়িত বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা যা বলেছেন, তা তারাই ভালো জানেন। আমি সেটি নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আর রাতে র‌্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা এ ন্যক্কাজরনক ঘটনাটির ছায়া তদন্ত করছিলাম। পরে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন যুবলীগ নেতা আসাদুলকে আটক করা হয়। তখনই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হামলার কথা তিনি স্বীকার করেছিলেন। তবে আমরা তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের তেমন সময় পাইনি। কারণ কাউকে আটকের পর দ্রুত স্থানীয় থানায় সোপর্দের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, এ ঘটনাটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করেছে ডিবি ও স্থানীয় পুলিশ। তাদের তথ্য-উপাত্তই বেশি যৌক্তিক হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা পুলিশকে অভিনন্দন জানাই এ ঘটনার রহস্যের উদ্ঘাটনের জন্য। তবে আসাদুলকে কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়েই তার দোষের বিষয়টি জানিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন র‌্যাবের এ মুখপাত্র।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় দুটি বাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদনের প্রশ্নই আসে না, কারণ তারা এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এখন তারা যে তথ্য দিয়েছে তা শুধু গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্য। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না দেয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্তব্যের সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, গত ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তরা ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ চত্বরে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করে। হত্যার উদ্দেশ্যে তারা ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী শেখকে কুপিয়ে ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। সকালে আহত বাবা-মেয়েকে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে ইউএনও ওয়াহিদাকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। তিনি বর্তমানে ঢাকার আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App