×

জাতীয়

ক্লাস ও পরীক্ষার কী হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩১ এএম

ক্লাস ও পরীক্ষার কী হবে

এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় মন্ত্রণালয়!

করোনাকালে সাময়িক লকডাউনের পর সবকিছু স্বাভাবিক হলেও দেশের শিক্ষাঙ্গন এখনো স্থবির। দীর্ঘ বন্ধের কারণে থমকে আছে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত। পরিস্থিতি উত্তরণে শিক্ষা প্রশাসন নানা পরিকল্পনার কথা জানালেও কী কী সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে- তা প্রকাশ করেনি। ফলে কাটেনি শিক্ষা খাতের অনিশ্চয়তাও। কেউ কেউ বলেছেন, শিক্ষাবর্ষ বাড়িয়ে পুরো শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী সিলেবাস শেষ করতে। কারো কারো মতে, বছরের প্রথম আড়াই মাসে যা পড়ানো হয়েছে তার ভিত্তিতে শিক্ষাবর্ষ শেষ করা উচিত। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, করোনাকাল ও করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার কী হবে?

বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সময়ের মধ্যে পাঠদান বন্ধ থাকার পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি সাময়িক পরীক্ষা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় দ্বাদশ শ্রেণিতে অটো প্রমোশন দিয়েছে কলেজগুলো। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কবে নেয়া যাবে তার কোনো তথ্য এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আগামী ৩ অক্টোবরের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলেও পাঠদান না হওয়ার কারণে জেএসসি, জেডিসি, পিইসি, ইইসি এবং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। ১ মাস পর ২০২১ সালের মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে কীভাবে নির্বাচনী পরীক্ষা হবে- তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। চলতি বছর পাঠদান না হওয়ায় ২০২১ সালের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কীভাবে হবে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে ফেব্রুয়ারিতে।

এছাড়া উচ্চ শিক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাড়ে ৪শ পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেছে। সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও বাতিল হয়েছে বহু পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা বাতিল ও ক্লাস না হওয়ায় জন্ম নিয়েছে সেশনজট। চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না হওয়ায়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো একটি সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায়নি। যেসব সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছেন তারাও ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কোভিড মহামারি একটি বৈশ্বিক সংকট, যেটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও একধরনের সংকটে ফেলেছে। কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংকট মোকাবিলার পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, সামনের দিনগুলোতে ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনায় স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। চলতি বছরের মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের অনলাইনে কলেজে ভর্তির কার্যক্রম চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চললেও তা টেকসই হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী। চলতি বছরের ১ এপ্রিল উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এই পরীক্ষাসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর সাড়ে ৫ মাস পার হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। এই সময়ে কলেজগুলোর সঙ্গেও শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি ধরে রাখতে না পেরে অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ালেখা বিমুখ হয়ে পড়েছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি- জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে প্রায় ৭ মাস ধরে শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অল্পবিস্তর পড়াশোনা চলছে। ক্ষতি সামলাতে অটো প্রমোশনসহ বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করা হচ্ছে। তবে উচ্চ শিক্ষায় অটো প্রমোশন দিয়ে কখনোই গুণগত মান কমানো উচিত হবে না।

রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষার চ্যালেঞ্জ আরো ঘনীভূত হয়েছে

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ সম্পর্কে বলেন, করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশে সংকটের পাশাপাশি কিছু অর্জনও ছিল। কিন্তু করোনায় অর্জনগুলো ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আগে চ্যালেঞ্জ ছিল, করোনায় চ্যালেঞ্জ আরো ঘনীভূত হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বৈষম্য। বৈষম্য এখন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এই বৈষম্যের কারণে এখনো আমরা জানতে পারছি না, করোনায় ঠিক কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা জানার জন্য স্বাধীন একটি সংস্থার মাধ্যমে ঠিকঠাক জরিপ প্রয়োজন। জরিপ তথ্য পাওয়া গেলে ক্ষতি পোষাতে নির্ভুল কাজ করা যাবে।

তবে করোনা পরবর্তী সময়ে ক্ষতি পোষাতে ৩টি প্রস্তাব দেন রাশেদা কে চৌধুরী। এর মধ্যে একটি হচ্ছে- জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার্থীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে পড়াশুনার ধরন ঠিক করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বার্তা দিয়ে বলতে হবে, তোমরা স্কুল-কলেজে আসো, তোমাদের স্বাস্থ্যসেবা বা সুরক্ষায় বিষয়টি সরকার দেখবে এবং সবশেষে শিক্ষা প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে। এই প্রণোদনা স্বচ্ছভাবে বণ্টন হয় কিনা- তাও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে কাজ হতে পারে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়বে বাল্যবিবাহ, শিশু প্রসূতির হার, শিশ মাতৃমৃত্যুর হার, শিশু শ্রম। এছাড়া এতদিন পড়াশোনার বাইরে থাকায় শিশুদের ক্লাসে মনোযোগী করাও কঠিন হয়ে পড়বে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না হওয়ায় ইতোমধ্যেই একটা জট তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে করোনা সংকটে তৈরি হয়েছে সেশনজট। কিন্তু সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজতে গিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের সঙ্গে আপস করা যাবে না। তাহলে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অটোপ্রমোশন পেলে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। পাল্লা দিতে পারবে না বিশ্বে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তবে অনেকেই বলেছেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা কমাতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট সহজলভ্য করে মোবাইল ও ল্যাপটপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য এ সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ জন্য টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাসের ব্যবস্থা বরং কিছুটা সহজ পদ্ধতি।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির (বিডিইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর বলেছেন, করোনাকালের দোহাই দিয়ে শিক্ষার ধারাবাহিকতা নষ্ট করা যাবে না। কারণ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে পরীক্ষা না হলেও দোষের কিছু নয়। কিন্তু লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে জাতিকে খেসারত দিতে হবে। তার মতে, পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়, শিক্ষটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই শিক্ষাটা কিভাবে দেয়া যায় সে নিয়েই কাজ করতে হবে।

এদিকে, করোনার ক্ষতি পোষাতে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা টিভি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে শ্রেণিপাঠ চালু রাখতে সংসদ টিভিতে সম্প্রচারের পর রেডিওতে সম্প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবার শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রচারের জন্য ‘শিক্ষা টিভি’ চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে শিক্ষা টিভির বিষয়ে বিটিভির মহাপরিচালক এস এম হারুন-অর-রশিদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজিদের কমিটির সদস্য করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেডিও ও টেলিভিশনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম চালু থাকলেও এতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান থাকা ও সব জায়গায় এই দুই গণমাধ্যম না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পাঠদানে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে এই কার্যক্রমের বাইরে থাকতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকে। তাই সরকার এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য চালু করতে যাচ্ছে ‘শিক্ষা টিভি’। এ টিভির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রচার করা হবে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, শিক্ষা টিভি চালুর বিষয়ে সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবও সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে শিক্ষা টিভি চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বিটিভির মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা অধিদপ্তরের ডিজিদের কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এ বিষয়ে সবার মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App