×

মুক্তচিন্তা

উন্নয়নের ‘ঘুণপোকা’ অর্থ পাচার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫৯ পিএম

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা! দেশের টাকা বাইরে পাচারের গল্প আশৈশব শুনছি। ওপরের তথ্য সঠিক হলে বলতেই হবে এখনো টাকা পাচারের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। অর্থ পাচারের এসব ঘটনায় দেশের ব্যাংকগুলোর ভ‚মিকা আছে কিনা তা দেখার প্রয়োজন আছে। কারণ ব্যাংকসমূহের জালিয়াতির মাধ্যমে বিগত ১০ বছরে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুটপাটের কথাও আমরা জানি। বেসিক, জনতা, ফরমার্সসহ কয়েকটি ব্যাংকর নাম এ ধরনের ঘটনায় ওঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার সম্ভব হলেও অনেক পাচারকারীর প্রিয় ব্যাংক ‘সুইজ ন্যাশনাল ব্যাংক’। সুইজ ব্যাংকের ভল্ট অত্যন্ত শক্তিশালী! কোনো রাষ্ট্র চাইলেই সেখান থেকে পাচারকারীর সঞ্চিত অর্থ ‘সহজেই’ ফিরিয়ে নিতে পারে না। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার আইনি লড়াইয়ের পথ বড়ই দীর্ঘ! কিন্তু পাচার রোধে রাষ্ট্রের কি কোনোই দক্ষতা নেই? নাকি ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’ আপ্ত বাক্যটিই আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়তি! দেশের অর্থ-গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষতা নিয়েও তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন এই যে, আমরা কি ফি বছর একই গল্পের পুনরাবৃত্তি শুনব আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ব? দেশের বাইরে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুক‚ল্য প্রয়োজন। বিএনপির শাসনামলে বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে দলটির প্রভাবশালীদের যোগসাজশ ছিল। কিন্তু বিগত সাত বছরে কার ছত্রছায়ায় এই বিপুল অর্থরাশি বিদেশে পাচার হলো? ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার অর্থাৎ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা কে, কীভাবে পাচার করল? টাকা গোপনে পাচার হয় ঠিকই কিন্তু ‘অদৃশ্য শক্তি’র কারো না কারো কাছে তা প্রকাশও হয়। সুতরাং এই গোপন একেবারেই গোপন নয়। গোপনীয়তা রক্ষায় অনেকে সততার (!) পরিচয় দিয়ে থাকেন! ফলে নির্বিঘ্নে অবৈধ পন্থায় অর্থ পাচার হয়ে থাকে। দেশের বারোটা বাজুক সমস্যা নেই; নিজের উন্নতি ঘটুক! উন্নতি ঘটছে পাচারকারী এবং গোপনীয়তা রক্ষায় সহায়তাকারী উভয়েরই! এই হলো দেশপ্রেমের নমুনা! এ রকম দেশপ্রেমিক আছে বলেই স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল আগামী ৫০ বছরেও দেশটি সেখানে পৌঁছতে পারবে না। কেননা এই ৫০ বছরে পাচারকারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে গণিতের ‘ঐকিক নিয়মে’ই। দেশের বিপুল টাকা পাচার হওয়ার কথা শুনলে মনটা সংকুচিতই হয়ে যায়! হতাশও বোধ করি। চারদিকের এমন দশা দেখে দেশটির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের জন্য দুঃখও হয়! এক সময় উপদেশ শুনেছি ভালো ছাত্র হও, ভালো মানুষ হও। ভাগ্যচক্রে নিজেও সেই একই উপদেশ ছাত্রছাত্রীদের দিই। পাশাপাশি এও বলি যে, ‘ভালো ছাত্ররা যদি ভালো মানুষ না হয় তা হলে তার চেয়ে ক্ষতির আর কিছু হতে পারে না। একজন খারাপ ছাত্র মানুষ হিসেবে খারাপ হলেও রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষতি হয় তুলনামূলক কম। কারণ সে রাষ্ট্রীয় বড় কোনো পদে যেতে পারে না। ফলে তার পক্ষে রাষ্ট্রের বা সমাজের বড় বড় ক্ষতি করাও সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে ভালো ছাত্ররা ভালো মানুষ না হওয়ার কারণে রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন হয়ে নির্বিঘ্ন চিত্তে নিয়মিত রাষ্ট্রের বড় বড় দুর্নীতি ও জনগণের বড় বড় ক্ষতি সাধন করেন।’ সাম্প্রতিককালের আলোচিত ‘বালিশকাণ্ড’, তিতাস গ্যাস সংযোগে ‘কেজি হিসেবে টাকা মেপে ঘুষ নেয়া’ এবং ‘পর্দাকাণ্ড’-এর মতো ঘটনায় তথাকথিত ভালো ছাত্ররাই জড়িত! বর্ণিত ঘটনাগুলোর প্রথম দুটির পশ্চাতে ‘প্রকৌশলী’ এবং শেষটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডাক্তাররা! অবশেষে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি কাণ্ডের জন্য গত সপ্তাহেই দুজন ডাক্তার স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু চাকরিচ্যুতির চেয়েও কঠিন শাস্তি তাদের প্রাপ্য। দুর্নীতিবাজদের ডাক্তারি সনদও বাতিল করা প্রয়োজন। (বি.দ্র. এ পর্যন্ত লেখায় প্রকৌশলী ও ডাক্তার প্রসঙ্গ এসেছে কেবল সাম্প্রতিক ইস্যু বিবেচনায়। দেশের প্রায় প্রত্যেক পেশাজীবী গোষ্ঠীর জন্য একই কথা প্রযোজ্য)। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজে যারা পড়াশোনা করেন আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক এমনকি সব ধরনের ‘বাণিজ্যিক’ সূচকে তাদের ‘ভালোত্ব’ তথা মেধা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না। ওপরে বর্ণিত ঘটনাবলি দেখেশুনে এবং গত বছর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার হত্যা ইস্যুতে সম্প্রতি বুয়েটের ২৫ ছাত্রের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলেও কেন যেন অভিযুক্ত ওই ২৫ মেধাবী (!) আসামির জন্য মনের ভেতর কোনো খেদ অনুভব করছি না। এসব মেধাবীর পক্ষে মানসিকভাবে দাঁড়ানো কিংবা মানবিক কোনো সমর্থন দিতেও মন সায় দেয় না! কেবলই মনে হয় যারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী আরেকজন বন্ধু, ক্লাসমেট, কিংবা ছোট ভাইকে রাতের আঁধারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পারেন তারা রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন হলে এ দেশের সাধারণ মানুষকে মুহুর্মুহু হত্যা করতে পারবেন! সরাসরি ও শারীরিকভাবে হত্যা না করলেও পরোক্ষভাবে এ দেশের জনগণকে তারা হত্যা করবেন। এসব ‘অমানবিক’ ভালো ছাত্রদের দ্বারাই আমাদের দেশের কংক্রিটের স্থাপনায় রডের বদলে বাঁশের চটি ব্যবহারের ঘটনা ঘটে! আবার রোগীর পেটের ভেতর সুই-সুতা, গজ-ব্যান্ডেজ রেখেই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করে মোটাদাগের বিল স্বজনদের কাছে ধরিয়ে দেয়ার নজিরও কম নেই! এরূপ প্রকৌশলী বা ডাক্তারের সংখ্যাই দেশে বেশি এমন অভিযোগ করছি না। কিন্তু এসব তো ঘটছেই। আবার কত সহজেই না এসব ভালো ছাত্ররূপী অমানুষরা ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়েও আসছেন! শুধু তাই নয় সমাজের ততোধিক বড় স্থানগুলো এরাই অলঙ্কৃত করছেন। আমরা এমন ‘ভালো ছাত্র’ নিয়ে কী করব যদি তিনি ‘ভালে মানুষ’ না হন! এদের পেছনে থাকা রাষ্ট্রীয় পদগুলো কেমন অসহায় তাও ভাবি। ভালো মানুষ তথা সৎ মানুষের খোঁজে আমরা কোথায় যাব? রাজনৈতিক অঙ্গনে? সেখানেও ভালো মানুষ আছেন। আছেন ভয়ঙ্কর মানুষরূপী দৈত্যও! এই যে আমরা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের গল্প শুনে শুনে জীবন পার করছি, তবু সেই গল্পের অপনায়করা তো রাজনৈতিক অঙ্গনে তবিয়তেই আছেন। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইজ ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৮’ শীর্ষক যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ২৭০ কোটি মার্কিন ডলার। যখনই বা যে সরকারের আমলেই পাচার হোক, এ অর্থ রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে তা ফিরিয়ে আনতে হবে। ‘টাকা আনা পাই’ হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের অর্থ ফেরত চাই। এ অর্থ ফিরিয়ে আনা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশের সম্মুখে সেই কঠিন কাজটি করারও ইতিহাস আছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বেগম জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে ২০১২-১৩ সালে ফেরত আনা হয়েছিল। বিএনপি নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে হংকংয়ে পাচারকৃত ৩২১ কোটি টাকা ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে ১৬ কোটি ফেরত আনার জন্য হংকংয়ের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট’ (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আমরা গত ৭ বছরে পাচার হওয়া টাকার বিষয়েও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা দেখতে চাই। অনেক সময় অর্থ পাচারের পেছনে থাকে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়। অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের মধ্যেও সৎ মানুষের সংকট তৈরি হয়েছে। গত ৭ বছরে কীভাবে এত অর্থ পাচার সম্ভব হলো তা আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করে দায়মুক্ত হওয়ার প্রয়োজন আছে। আওয়ামী লীগ অনেক বড় একটি রাজনৈতিক দল। তার দায়িত্বও অনেক বড়। এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় সৎ, যোগ্য ও ভালো মানুষের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করার প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রয়াসটি পাচারকারী নামক এসব ঘুণপোকার আক্রমণে তিলে তিলে বিনষ্ট হচ্ছে, উন্নয়ন সূচকের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতেও বিলম্ব ঘটছে। আওয়ামী লীগেরই সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতাদের উচিত এসব ঘুণপোকার কবল থেকে দল এবং দেশকে রক্ষা করা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ আর জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ‘২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র’ বাস্তবায়নে সব বাধা দূর করতে হবে। দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাপূর্বক অবৈধ পন্থায় বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরানোরও উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনীতির মাঠেও ভালো নেতাকর্মীর পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রীর স্বপ্নের বাইরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সৃষ্টিশীল স্বতন্ত্র স্বপ্ন থাকলেও তার মিলন ঘটাতে হবে সোনার বাংলাকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ের সঙ্গে। সবাইকেই মনে রাখতে হবে এর বিকল্প মানেই বিচ্যুতি। আর কোনোরূপ বিচ্যুতিই আমাদের কাম্য নয়। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App