×

সাময়িকী

আহমদ রফিক কালের ব্যতিক্রমী একজন মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:২৬ পিএম

আহমদ রফিক কালের ব্যতিক্রমী একজন মানুষ

আহমদ রফিক

জন্মদিন

সংগ্রামে ও সৃজনে নিবেদিতপ্রাণ যেসব নাম আমাদের সামনে আসে, আহমদ রফিক- আমাদের রফিক ভাই তাঁদের অন্যতম। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মননচর্চার ধারায় তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন স্বতন্ত্র এক প্রতিষ্ঠান। এ দেশে যাঁরা অন্যের স্বার্থের জন্য নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, আহমদ রফিক সেই বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্বের একজন। সাধারণ মানুষের স্বার্থকে, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণকে রফিক ভাই নিজের স্বার্থ নিজের কল্যাণ ভেবেছেন আজীবন।

আহমদ রফিক পড়ালেখা করেছেন চিকিৎসা শাস্ত্রে, কিন্তু কখনোই পেশা হিসেবে ওই বিদ্যাকে তিনি কাজে লাগাননি। ওই বিদ্যা কাজে লাগালে জাগতিক উন্নতি হতো- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে। আহমদ রফিক প্রকৃত প্রস্তাবে জীবনে কোনো পেশাকেই গ্রহণ করেননি। বরং বলা যায়, লেখাটাকে গ্রহণ করেছেন নেশা হিসেবে। অ্যাকাডেমিক জগতের লোক না হয়েও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি তিনি গবেষণামূলক অনেক বই লিখেছেন- যেসব বই গুণে-মানে অনন্য। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, রাজনীতি ও সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও গভীর চিন্তাশ্রয়ী রচনা বাঙালির মমনচর্চার দীপ্র স্বাক্ষর হয়ে বহুকাল টিকে থাকবে।

কৈশোর থেকেই আহমদ রফিকের চেতনায় বাসা বেঁধেছিল সংগ্রাম ও সৃজনের যুগল সত্তা। বাঙালি সত্তায় তাঁর বিশ্বাস দেখা দিয়েছিল স্কুলজীবন থেকেই। প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক জীবন-বিশ্বাস তিনি ধারণ করেছেন কৈশোর থেকেই এবং সুদীর্ঘ নব্বই বছরের সাধনায় তা ক্রমে হয়ে উঠেছে অনেক দৃঢ় ও গভীর। এখন আহমদ রফিক নামটাই আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে প্রগতিচেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রতীক, দীপ্র জ্ঞানবৃক্ষের স্মারক। শত প্রলোভন আর প্রতিক‚লতার মুখেও নিজের আদর্শ থেকে একচুল বিচ্যুত হননি আহমদ রফিক। মানব কল্যাণকেই তিনি ভেবেছেন নিজের কল্যাণ। অর্থ আর বিত্তের ব্যাপারে তিনি সর্বদা আছেন নির্মোহ। চারদিকে যখন আত্মাসাৎ আর লুণ্ঠনের মহোৎসব, তখন তিনি গবেষণার জন্য উত্তর-প্রজন্মকে উৎসাহিত করার মানসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করেছেন একের পর এক ট্রাস্ট ফান্ড। গবেষণার জন্য এই যে অর্থ প্রদান- এমন দৃষ্টান্ত তো আমাদের সমাজে খুব একটা নেই।

স্কুলজীবন থেকেই আহমদ রফিক সংশ্লিষ্ট হন প্রগতিশীল বাম রাজনীতির সঙ্গে। তিনি যখন ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন বাম রাজনীতির সংগঠক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আহমদ রফিক। উত্তরকালে ভাষাসংগ্রামীদের সংঘবদ্ধ করা এবং ওই আন্দোলনের চেতনা বিস্তারেও আহমদ রফিক পালন করেন ঐতিহাসিক ভ‚মিকা। কিন্তু বাম রাজনীতিতে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব ও নানামাত্রিক তাত্তি্বক বিভাজন তাঁকে পীড়িত করে এবং এক সময়ে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে, রাজনীতির জগৎ থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। তবে সুস্থ এবং গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি তিনি আছেন সর্বদা শ্রদ্ধাশীল এবং পরোক্ষ কর্মী সংগঠক চিন্তক।

আহমদ রফিক একজন নিষ্ঠ গবেষক। ভাষা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর গবেষণা বাঙালির অনন্য সম্পদ। এই দুই ধারায় গবেষণাকর্মের জন্য বাংলাভাষী মানুষের কাছে তিনি চিরকাল বরণীয়-স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, উভয় বাংলায় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গ্রন্থ প্রণেতা হিসেবে সংখ্যার দিক থেকে তিনি আছেন সবার শীর্ষে। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে আহমদ রফিকের বইয়ের সংখ্যা বিশের অধিক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আহমদ রফিক বই লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, বিষ্ণু দে, চে গুয়েভারা, বাংলাদেশেআহমদর কবিতা, আধুনিক বাংলা কবিতা, দেশবিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ- এসব ব্যক্তি ও বিষয় নিয়ে- ভাবা যায়! তাঁর প্রতিটি বইয়ে আছে নিষ্ঠা ও পাণ্ডিত্যের পরশ। তিনি কবিতা লিখেছেন, আছে তাঁর একাধিক কবিতার বই, আছে ছোটগল্প, পত্রিকার কলাম আছে, সম্পাদনা করেছেন ‘নাগরিক’ নামের উচ্চমানের সাহিত্যপত্র।

বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সাহিত্যচর্চায় আহমদ রফিক পরিণত হয়েছেন দীপ্র এক প্রতিষ্ঠানে। এ ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের পতিসরকে নতুনভাবে আবিষ্কার তাঁর উল্লেখযোগ্য এক কাজ। এক সময়ে নব্বইয়ের দশকে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র উভয় বাংলায় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য এক সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।

নিভৃতচারী-নিরাসক্ত, নির্লোভ-নির্মোহ এবং মর্মে মর্মে নিঃসঙ্গ ও অন্তর্মুখী আহমদ রফিক আমাদের কালের ব্যতিক্রমী এক মানুষ, অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্ব। সুস্থ ধারায় উন্নত রুচি এবং প্রগতিশীল জীবন বিশ্বাসের আলোয় সুদীর্ঘ নব্বই বছর তিনি আছেন আমাদের সঙ্গে, বাঙালির পাশে। সংগ্রাম ও সৃজনের যুগলবন্দি মানুষ আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই। এমন মানুষ আমাদের পাশে থাকা মানেই আমরা সাহসী মানুষ, সংগ্রামী মানুষ, সৃজনশীল মানুষ। তাই সংগ্রামে আমাদের সতেজ রাখার জন্য, সৃজনে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানানোর জন্য আহমদ রফিককে আরো বহু বছর আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে, থাকতে হবে বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে।

বিরানব্বইতম জন্মদিনে আহমদ রফিক, আমাদের রফিক ভাইকে জানাই বিনত শ্রদ্ধা, গভীর ভালোবাসা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App