×

মুক্তচিন্তা

অধিকার এবং সেবা পরিস্থিতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫৬ পিএম

অধিকার এবং সেবা পরিস্থিতি
বিশ্বজুড়ে নারীরা মজুরি ও মজুরিহীন নানা উৎপাদিকা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হলেও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিমাপের সরকারি হিসাবে তা এ যাবৎকাল উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। প্রতিটি দেশেই পুরুষের বাইরেও নারীরা কম মজুরিতে দীর্ঘ সময় ধরে নিকৃষ্ট ধরনের কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়। নারীর অর্থনৈতিক কার্যক্রম তাই কম মজুরি, সম্পাদনশীলতা এবং অনিশ্চিত ধরনের কর্মসংস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উচ্চ মজুরির কর্মসংস্থানে পুরুষদেরই প্রাধান্য দেখা যায় এবং কম মজুরির কাজে নারীর আয় পুরুষের আয়ের ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ কম। সমান কাজে সমান মজুরি লাভের সুযোগ, আর্থিক ঋণ প্রাপ্তি, সম্পদের মালিকানা লাভ ও উত্তরাধিকার অর্জন নারীর এসব অর্থনৈতিক অধিকার বাস্তবে বিরাজ করে না কিংবা কদাচিৎ করলেও প্রচলিত রীতিনীতি ও ধর্মীয় সংস্কারের দ্বারা তা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এছাড়া আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে না পারায় অধিকাংশ দেশের নারীরা আয় উপার্জনের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশ্বের ৯৬ কোটি নিরক্ষরের দুই-তৃতীয়াংশ যখন নারী তখন তাদের অর্থনৈতিক অধিকারহীনতার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে শ্রমবাজারে নারীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এখনো কিন্তু নারীর অর্থনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করেনি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আজো বহুমুখী বৈষম্যের শিকার। এছাড়া লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন ও জনজীবনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এ ধরনের নির্যাতন সমাজে ক্রমবর্ধমান হারে নারীদের রাজনৈতিকভাবে কর্তৃত্বশালী হয়ে ওঠার বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে প্রতিফলিত করে। নারী ও শিশুবান্ধব নগর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনে নারী ও শিশুরা যেন নিরাপদে চলাচল করতে পারে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। নারী ও শিশুর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয় এমনভাবে নগর পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। নগর পরিকল্পনায় অনেক বেশি পাবলিক স্পেসের ব্যবস্থা থাকা দরকার। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টার প্রয়োজন। নারী ও শিশুবান্ধব নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় জরুরি। সব ধরনের পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। বেশি টাকা খরচ করে নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য পার্ক না করে, স্বল্প টাকায় সবার জন্য উন্মুক্ত পার্ক করতে হবে। নারীবান্ধব নগর তৈরির পাশাপাশি কিশোরীদের বিষয়টি আলাদাভাবে দেখতে হবে। কারণ কিশোরীদের এমন অনেক ধরনের প্রয়োজন থাকে, যা অন্যদের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো নগর সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত হতে পারেনি। নগরে দরিদ্রদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ ধনীরা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুবিধা সহজেই গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু দরিদ্ররা সে সুবিধা কখনই পায় না। নগরে নারী ও শিশুরা সমস্যায় পড়লে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ থাকা জরুরি। কিন্তু তারা সমস্যায় পড়লে প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগই বেশি। নিরাপদ নগর গড়তে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও আচরণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। বর্তমানে নগরের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। আমাদের নগরগুলো নারী ও শিশুবান্ধব নয়। এ নগর সবার জন্য নয়। এ নগর সবলের জন্য। আমাদের নগর বৈষম্যমূলক ও বিভক্ত। নগরে যে শ্রেণিবৈষম্য ও বিভক্তি আছে, তা বহুতল ভবনের ছাদে উঠলেই বোঝা যায়। এখনো আমাদের সমাজে উন্নত ডে-কেয়ার সুবিধা নেই। বহুদিন ধরে বলে যাচ্ছি, আমাদের ডে-কেয়ার সেন্টার দরকার। যেখানে নারীরা তাদের সন্তানকে নিরাপদে রেখে কর্মক্ষেত্রে যাবেন। আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে একটা প্রতিষ্ঠানে কতজন নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলে একটা ডে-কেয়ার সেন্টার দরকার। খুঁজে দেখলে এমন প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না, যারা এ আইন মানে। ডে-কেয়ার সেন্টার যে শুধু উচ্চবিত্তের জন্য প্রয়োজন, তা নয়। আমাদের পোশাক কারখানার কর্মীদের একটা বিরাট অংশ নারী এবং অধিকাংশের সন্তান আছে। এই সন্তানরা আমাদের মানবসম্পদ। তাদের সঠিক পরিচর্যা ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। ১৮ বছরের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে যদি পড়াশোনায় ভালো হয়, তবে ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, আশপাশের মানুষের সঙ্গে একরকম যুদ্ধ করে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর একজন পোশাককর্মীর ক্ষেত্রেও কিন্তু পরিবারের সঙ্গে একরকম যুদ্ধ করে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আসলে নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের কতখানি স্বাধীনতা আছে, সেটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যে মেয়েটি সুশিক্ষিত, সে আমাদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। কিন্তু বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আইনে যে মাতৃত্বকালীন ছুটির কথা বলা আছে, আমরা কি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, নারীরা সে ছুটি পান? ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন বাসায় গৃহপরিচারিকারা কাজ করতে এসে তিনবেলা খাবার জুটছে ঠিকই কিন্তু গৃহকর্তার লালসার হাত থেকে তাদের মুক্তি মেলেনি। তাই তারা সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। জরিনা ও সখিনার মতো এ রকম বহু শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করতে এসে নির্মম শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনে অনেক সময় তাদের মৃত্যুও হচ্ছে। এখন সারাদেশে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার পরিমাণ বৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন ও হত্যা হচ্ছে। এছাড়া শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও বাড়ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। শিশু ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে সাজা কার্যকর করতে পারলে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, অপহরণের পর হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, রাজনৈতিক বা পারিবারিক দ্ব›দ্ব, খেলা নিয়ে সংঘর্ষ, জমিসংক্রান্ত ও অন্যান্য বিরোধের জের, যৌতুকের কারণসহ বিভিন্ন কারণে শিশুরা খুন হচ্ছে। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত শিশু খুনের ঘটনা পর্যালোচনা করেও দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড়দের দ্বন্দ্বে পরিবারের শিশুটিকে হত্যার জন্য টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ‘সমাজে শিশু হত্যা চলছেই প্রায় দিনে গড়ে একটি শিশু হত্যার শিকার হচ্ছে। বছর শেষে এ চিত্র কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা যাচ্ছে না। আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধের শিকার হওয়া পরিবারের মধ্যে আইনি সহায়তা নেয়ার ব্যাপারে হতাশা দেখা দেয়।’ পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা যে কোনো কারণে পরিবারের শিশুটিকে অপহরণ করা হচ্ছে। বাবা-মা সন্তানকে খুন করে ফেলছেন। সর্বত্র সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাবা, মা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে অবশ্যই শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে। ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ইভটিজিং বা অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে ধরনের আন্দোলন হয়েছিল, সে ধরনের আন্দোলন প্রয়োজন। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App