নিউ নরমাল জনজীবনে টেলিমেডিসিনের পসার
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫১ এএম
টেলিমেডিসিন
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মনোয়ারা খাতুন (৬৯)। নিয়মমাফিক চেক-আপের জন্য যান বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সজলকৃষ্ণ ব্যানার্জীর কাছে। দেশে করোনা সংক্রমণের পর এক্ষেত্রে অনেকটাই বদল হয়েছে। মোমেনা খাতুনের ছেলে মোমিন রহমান সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ডা. সজল ব্যানার্জী চেম্বারে বসেন না। তবে যেসব রোগী চেম্বারে আসেন তাদের সেবা দিয়ে থাকেন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে। সিরিয়াল নিয়ে ওই ভাবেই মাকে চিকিৎসক দেখিয়েছেন মোমিন রহমান। তবে এভাবে চিকিৎসা পেয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন মনোয়ারা খাতুন। তার মতে, সরাসরি রোগীকে দেখে চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা যতটা বুঝতে পারেন- এই পদ্ধতিতে তা সম্ভব নয়।
সৃজন দেবের (১৭) গত বছর ডিসেম্বর মাসে নাকের সমস্যা নিয়ে শরণাপন্ন হন বিখ্যাত নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্তের। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তিন মাস পর আবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল সৃজনের। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। আগস্ট মাসের শেষের দিকে সৃজন চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নেন। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমানের কাছে নিয়মিত চেকআপ করান নেপাল সাহা (৭৫)। তিনিও টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন। মনোয়ারা খাতুন, সৃজন দেব কিংবা নেপাল সাহার মতো অসংখ্য রোগী সেবা নিচ্ছেন টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত ৩ লাখ ২৭ হাজার ৬২৬ জন মানুষ টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ বিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন।
মূলত মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকরা কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়াটাই টেলিমেডিসিন সেবা। বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে যারা যাচ্ছেন, তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহযোগী চিকিৎসকের কাছে তাদের সমস্যার কথা বিস্তারিত বলছেন। সহযোগী চিকিৎসক অনলাইনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে জানাচ্ছেন। কিছু কিছু চিকিৎসক ফেসবুকে গ্রুপ খুলে সেগুলোতেও পরামর্শ দিচ্ছেন রোগীদের। পুরনো রোগীরা তাদের প্রেসক্রিপশন হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবারে পাঠিয়ে দিয়ে নিচ্ছেন নতুন পরামর্শ। এর সবই চলছে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে।
গত মার্চে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর ঢাকাসহ দেশজুড়ে হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকদের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংকট তৈরি হয় এবং বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন সেবা চালু করে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। এরপর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালসহ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল এ সেবা চালু করে। জেলা উপজেলা পর্যায়েও টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই সেবা। চাহিদা ও সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো চিকিৎসকদের জন্য টেলিমেডিসিন গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এই গাইডলাইন তৈরি করেছে। বিএমডিসি বিশ্বাস করে, এই গাইডলাইন চিকিৎসকদের রোগীর স্বাস্থ্যসেবা দিতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত বলেন, প্রযুক্তি আমাদের সবকিছু সহজ করে দিয়েছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামের একজন সাধারণ মানুষও টেলিফোনে রাজধানীর একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাচ্ছেন। এটা বর্তমান সময়ে বড় একটি সেবা। যা চিকিৎসাসেবাকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। প্রত্যেকটা দুর্যোগে ক্ষতির পাশাপাশি সম্ভাবনাও দেখা দেয়। আর করোনা আমাদের টেলিমেডিসিনের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি (স্বাচিপ) অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সেনাল মনে করেন, দেশে ভার্চুয়াল স্বাস্থ্যসেবার এক শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে- যা করোনা পরবর্তী সময়েও স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে মেডিকেল অ্যানথ্রোপলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস মনে করেন, যে কোনো রোগ নির্ণয়ের নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে, যা টেলিমেডিসিন নয়। তবে আপদকালীন সময়ে এ পদ্ধতি কিছুটা কাজে লাগতে পারে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, টেলিমেডিসিন সেবা একটি করপোরেট কনসেপ্ট। আমাদের দেশে এই করোনার আপৎকালীন সময়ে এই পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। আগামীতে এই পদ্ধতি কতটা সফল হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। এই পদ্ধতিতে কোনো রোগের চ‚ড়ান্ত নির্ণয় সম্ভব নয়। তবে প্রতিরোধমূলক রোগগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা সম্ভব।