×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংকিং খাতে বিশ্বমানের সাইবার নিরাপত্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:১১ পিএম

একটা সময়ে আইটির জন্য আলাদা নিরাপত্তা বিভাগ বলতে কিছু ছিল না ব্যাংকগুলোতে। আমরা সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা সাফল্যগুলো ভোগ করেই পরিতৃপ্তি ও সন্তুষ্টিতে আচ্ছন্ন থাকছি। সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তেমন সিরিয়াস না হওয়ায় এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র।

হ্যাকিং বা ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ চুরি হতে পারে- তেমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি সতর্কাবস্থা জারি করা হয়েছে। এমন আশঙ্কায় এর আগে সতর্কতা জারি করে একাধিক মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। তারা বলেছে, উত্তর কোরিয়া সরকারের সঙ্গে যুক্ত একদল হ্যাকার এটিএম বুথ ও ভুয়া লেনদেনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে। এই হ্যাকার দলের নাম ‘বিগল বয়েজ’। দলটি বিভিন্ন হ্যাকার গোষ্ঠীর একটি জোট। সতর্কতা জারির পর থেকে দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে সতর্কবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে এটিএম বুথের লেনদেন ও ক্রেডিট কার্ডের যাবতীয় লেনদেনে। এ ক্ষেত্রে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। অনেক ব্যাংক রাতের বেলা অনলাইন ব্যাংকিং ও এটিএম বুথের লেনদেন বন্ধ রেখেছে। এছাড়া বিদেশিদের যে কোনো লেনদেনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। এটিএম বুথে প্রবেশে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্রের সম্ভাব্য সাইবার হামলা প্রতিরোধে বিশ্বের অন্য দেশের ব্যাংকগুলোতেও সতর্কাবস্থা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় উত্তর কেরিয়ার হ্যাকার গ্রুপ জড়িত ছিল বলে আগে জানানো হয়। এ কারণেই তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব ব্যাংককে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়। হঠাৎ করে ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকের গ্রাহকদের কিছুটা ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে ইদানীং।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। সর্বস্তরের মানুষ এ বিষয়ে কৌত‚হলী হয়েছেন, সবার মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা ছড়িয়ে পড়েছিল। চুরি বন্ধ করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এ মধ্যে একটি হলো, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা দুর্বলতাগুলো অবিলম্বে কাটিয়ে ওঠা এবং অপরটি সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল তৈরি করা। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। চাইলেই আমরা এর বাইরে থাকতে পারব না। তবে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ভালো দিকের পাশাপাশি অনেক মন্দ দিকও আছে। মন্দ দিকগুলো মোকাবিলার জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। তা না হলে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ ‘হ্যাকড’ অন্যত্র পাচার হওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষ স্তম্ভিত না হয়ে পারেনি।

আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন ব্যাংকের সব গ্রাহক। আজকাল প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলোও। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ নানা চক্র। রাজধানী ঢাকা শহরের কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে একদল বিদেশির জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা চুরির চাঞ্চল্যকর ঘটনা জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে তদন্তের মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছে অনেক অজানা তথ্য। দেশের ব্যাংকিং খাতকে টার্গেট করে এটিএম বুথের যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক হ্যাকার গ্রুপের সদস্যরা ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। নীলনকশা অনুযায়ী তারা একের পর এক হানা দিচ্ছে বিভিন্ন এটিএম বুথে। ফলে ভয়াবহ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা। দেশের বিভিন্ন এটিএম বুথে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এবারই নতুন নয়। এর আগেও জালিয়াত চক্র বিভিন্ন সময়ে হানা দিয়ে সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। জানা গেছে, এটিএম যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক হ্যাকার গ্রুপ জালিয়াতি চক্রের গোপন যোগাযোগ রয়েছে। এসব কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা। সাপ্লাই সোর্সকে ধরতে না পারলে শুধু হ্যাকার গ্রুপের সদস্যদের আটক করে এ ধরনের ডিজিটাল জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হবে না। এর আগে এটিএম কার্ড ক্লোন করে জালিয়াতির মাধ্যমে বুথ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা কেবল ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্যই নয়, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্যও উদ্বেগজনক। যদিও বহু আগে থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করায় সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, গ্রাহক সবাই দারুণ এক উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে আরো উৎকণ্ঠার বিষয় হলো এ ধরনের ঘটনায় বিদেশিদের জড়িত থাকা।

এক সময় বিভিন্ন ব্যাংক শাখার ভল্টের তালা ভেঙে কিংবা সিঁধ কেটে ব্যাংকের ভল্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি, ডাকাতির ঘটনা সবাইকে চমকে দিলেও আজকাল তেমন ঘটনা অনেক কমে এসেছে। সময়ের বিবর্তনে ব্যাংকগুলো নতুন করে সাইবার তথা ডিজিটাল ঝুঁকির মধ্য পড়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার মতো ব্যাংক ডাকাতির ইতিহাসও পুরনো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে অপরাধের ধরন। আজকাল বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভব হলেও বাংলাদেশে তার প্রচলন ও প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের অপরাধ চক্রের সঙ্গে বিদেশি সংঘবদ্ধ চক্র জোট বেঁধে সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এখন নানা ধরনের ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ চুরির স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার পর ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ইতোমধ্যে সজাগ হয়ে উঠেছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।

সারা দুনিয়ায় ব্যাংক খাতে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে সাইবার অপরাধী কর্তৃক বড় অঙ্কের অর্থ চুরির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রকরা ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন অনেক আগেই। সাইবার অপরাধীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের নেটওয়ার্কে ভুয়া নির্দেশনা পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

একটা সময়ে আইটির জন্য আলাদা নিরাপত্তা বিভাগ বলতে কিছু ছিল না ব্যাংকগুলোতে। আমরা সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা সাফল্যগুলো ভোগ করেই পরিতৃপ্তি ও সন্তুষ্টিতে আচ্ছন্ন থাকছি। সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তেমন সিরিয়াস না হওয়ায় এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র। ব্যাংক খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, যার কারণে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে দারুণ গতির সঞ্চার হয়েছে। সেই আইসিটিকে ব্যাংক খাতের প্রধান একটি ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন। এখনো আইসিটিকে ব্যাংক খাতের মূল ব্যবসা থেকে আলাদা করে দেখার একটি মানসিকতা বহাল রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নতুন গতি সঞ্চারকারী আইসিটি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলিত অবস্থায় রেখে দিলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। এ খাতের নীতিনির্ধারকদের পুরনো মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে বাস্তবতার নিরিখে।

সাইবার ঝুঁকির বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিরাপদে-নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে মনোযোগী হতে হবে। একাধিক ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা তো অতি সাম্প্রতিক। সব ব্যাংককেই এখন তাদের অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা, সচেতনতা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেই পরিবর্তনগুলোর জন্যই প্রয়োজন যথাযথ অনুসন্ধান, দায় নির্ধারণ ও জবাবদিহিতা। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুরক্ষা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা দেশের কোনো ব্যাংকে না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে ও সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংক খাতের সর্বস্তরে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক সচেতন মনোভাব জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাতে বিশ্বমানের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App