×

মুক্তচিন্তা

পুলিশ কি জনগণের বন্ধু?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:০৪ পিএম

পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাস্তবে দেখেছি উল্টো। তাদের সৎ অফিসার বা সৎ কর্মীরা দেশের আর সব সেক্টরের মতো অবহেলিত। এরা পড়ে থাকেন অন্ধকারে। তাদের আছে প্রমোশন পোস্টিং বাণিজ্য। সে বাণিজ্যে হয় মামা-চাচা নয়তো টাকা লাগে। আর যারা তা পারে তারা মামা-চাচার জোর, টাকার জোর খাটিয়ে এমন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। পুলিশ কোন দেশে মানুষের বন্ধু সেটা জানার জন্য দূরে যেতে হয় না। তারপরও আমরা শিখব না। কারণ ট্রেনিং আর পদটাই এমন- যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।

বছরখানেক আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছিল, কোনো কোনো পুলিশকর্তার আচরণ জমিদারদের মতো। শুধু জমিদার? খুব বেশিদিনের কথা নয়। নুসরাতকে মনে আছে? হুমকি দেয়া, মেরে ফেলা, আগুন লাগিয়ে হত্যা করা কোনটা বাদ ছিল? মনে পড়ে এক তরুণী গিয়েছিল তার প্রতি অপমানের বিচার চাইতে। জবাবে ওসি কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে মরতে হয়েছিল তাকে। টিভিতে দেখেছিলাম তার ভাইয়ের আহাজারি। বেচারা বারবার বলছিল, এই লোক আমার বোনটারে পিটাইয়া মাইরা ফেলাইছে। এ লেখা যখন লিখছি খবরে দেখলাম ওসি প্রদীপের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এর আগে লিয়াকত বলেন, ‘ঠিক আছে, শেষ কইরা দিতাছি’।

পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলার এজাহারে এমনটাই উল্লেখ করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া। তিনি দাবি করেন, সিনহার মৃত্যুর পরও শরীর-মুখে কয়েকটি লাথি মারেন ওসি প্রদীপ। চেহারা বিকৃত করতে ওসি তার পায়ের বুট দিয়ে মুখে আঘাত করেন। ভিডিওচিত্র শুটের পর টেকনাফ থেকে কক্সবাজারে ফেরার পথে বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর ৫ আগস্ট আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় পরিদর্শক লিয়াকত আলী (৩১) ও প্রত্যাহার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া। এরপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ৯ জন আসামিকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ পুলিশ।

এমন সব ঘটনা এখন এত গা সওয়া কারো কিছু যায় আসে না। কী হয় শেষে? কিছু গালভরা কথা শুনি আমরা। প্রত্যাহার করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে। ক্লোজড করা হয়েছে। তারপর কিছুদিন গেলে কেউ আর জানে না কী হয়েছে। কোথায় সেই অফিসার আর কোথায় বিচার? এমন আর একটা ঘটনা এখন দেশের হট টপিক। এখানে আবার যোগ হয়েছে প্রদীপ দাস। যে কিনা ছিল ভারপ্রাপ্ত ওসি। ফোনালাপ থেকে তথ্য যাই বলুক ওই নামের কারণে জোশ প্রবাহিত অন্য খাতে। এ কথা বলি না প্রদীপ নির্দোষ। তদন্ত করে দেশে যত প্রদীপ আর তলায় যত অন্ধকার তা দূর করা এখন জরুরি।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যু রহস্য কবে কখন উদঘাটিত হবে কেউ জানে না। আদৌ হবে কিনা তাও জানা যাবে না। সবাই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব এড়াতে সচেষ্ট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখলাম নিজের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপিয়ে বেশ পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। সব যদি প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয় তো আপনারা আছেন কি করতে? মূল কথা হলো পুলিশ এখন মিলিটারিকে মারতে পারে। কে কাকে পিস্তল তাক করে কে আসলে মাদক পাচারকারী আর কে নিরপরাধ তাও রহস্যময়। ঘটনা যেহেতু বিচারাধীন আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারি না। আদালতের ওপর বিশ্বাস রাখাই সাধারণ মানুষের কর্তব্য। কিন্তু প্রশ্ন তো করা যেতেই পারে। সিনহার পর কি আর কোনোদিন এমন ঘটনা ঘটবে না?

একটি শিশুও বলে দিতে পারে অচিরেই আবার একটা ঘটনা ঘটে এই ঘটনাকে ভুলিয়ে দেবে। কিন্তু এই যে প্রবণতা মৃত্যুকে এত সহজ করে ফেলা সেটা বন্ধ হবে না। শুরুতে সবাই মনে করত ক্রসফায়ার শুরু হয়েছে বা হবে মাদক ব্যবসায়ীসহ ডাকাত-লুটেরাদের সাইজ করার কাজে। সে আশা ক্রমেই ফিকে হয়ে গেছে। উল্টো এখন শুনি ওসি প্রদীপরা মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের হয়েই নাকি ক্রসফায়ারের আদেশ দিত। আমরা নিশ্চয়ই সামাজিক মিডিয়া তোলপাড় করা মেয়েদের সেই ‘বাবা তুমি কানতেছো’র কথা ভুলিনি? জনপ্রিয় সেই মানুষটিকে একটা শব্দের সঙ্গে নিঃশেষ হওয়ার আওয়াজ শুনেছে বাঙালি। স্তব্ধ বাংলাদেশ শুধু শোনে আর দেখে আজ তার কিছুই বলার নেই।

সিনহা কি করেছিলেন বা লিয়াকত কি করেছিল তার কাহিনী আমরা না জানলেও যারা জানার ঠিকই জানবেন। কিন্তু স্বচ্ছতা নেই বলেই জাতি বা দেশ জানবে না। কাহিনীর পেছনের কাহিনী চিরকাল থেকে যায় অন্ধকারে। কিন্তু আমরা এটা বুঝে গেছি জেনে গেছি বাংলাদেশের জমিদার এখন পুলিশরা। তাদের হাতে সবকিছু। নারী-পুরুষ ভালো-মন্দ সব তাদের ইশারায় চলতে হয়। না হলে স্যার আমি হেরে গুলি করে দিছি এই কথার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় জীবন। এর নাম আর যাই হোক সুশাসন হতে পারে না।

এমন পরিস্থিতি ক’দিনে একা কারো সৃষ্ট না। এর পেছনে আছে দীর্ঘ সময়ের অপরাধপ্রবণ মানুষদের কর্মকাণ্ড। এরা সবাই মিলে যে সিন্ডিকেট আর লোভের চক্র সেটাই এখন হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী। আমরা সবাই জানি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আর প্রকৃত অপরাধীর বিচারেই আছে এর সমাধান। কিন্তু তা হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকলেও হয় না। কারণ মাঠে যারা আছেন তারা সবাই একে অপরের পৃষ্ঠপোষক।

ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি পড়ে বড় হয়েছি : পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাস্তবে দেখেছি উল্টো। তাদের সৎ অফিসার বা সৎ কর্মীরা দেশের আর সব সেক্টরের মতো অবহেলিত। এরা পড়ে থাকেন অন্ধকারে। তাদের আছে প্রমোশন পোস্টিং বাণিজ্য। সে বাণিজ্যে হয় মামা-চাচা নয়তো টাকা লাগে। আর যারা তা পারে তারা মামা-চাচার জোর, টাকার জোর খাটিয়ে এমন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। পুলিশ কোন দেশে মানুষের বন্ধু সেটা জানার জন্য দূরে যেতে হয় না। তারপরও আমরা শিখব না। কারণ ট্রেনিং আর পদটাই এমন- যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।

অথচ এই করোনাকালে মানবসেবায় চমৎকার অবদান আর মানবিক ভ‚মিকা রেখে পুলিশ হয়ে উঠেছিল নন্দিত। তাদের ভ‚মিকায় মানুষ এতটাই আনন্দিত আর কৃতজ্ঞ যে তাদের নিয়ে গান-কবিতা লেখা আলোচনাও হচ্ছিল প্রচুর। সেসব সুকাজে কলঙ্ক লেপে দিল মেজর সিনহা হত্যার ন্যক্কারজনক ঘটনা।

এর বিচার আর বিহিত না হলে সমাজে মানুষের মনে পুলিশ পুলিশই হয়ে থাকবে। তার আর মানুষ হওয়া হয়ে উঠবে না। বাংলাদেশের হাজার হাজার সৎ ও ভালো পুলিশের কারণেই এর বিচার হোক। মানুষ ও পুলিশের সম্পর্ক হোক বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App