×

মুক্তচিন্তা

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নেয়ার প্রত্যাশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:১১ পিএম

আওয়ামী লীগের তো এখন দুর্দিন যাচ্ছে না। বরং আওয়ামী লীগ সময়ের এই চ্যালেঞ্জকে যেভাবে মোকাবিলা করে চলছে সেটিকে আরো বেগবান করা গেলে দুর্নীতিবাজ, তদবিরবাজ, সন্ত্রাসী, ভ‚মিদস্যু, প্রশাসনের ওপর চড়াও হওয়ার নজির যারা স্থাপন করে তাদের দল থেকে বহিষ্কার এবং বিচারের সম্মুখীন করা গেলে আওয়ামী লীগের সামনের দিনগুলো আরো সুদিনের পরিণত হতে পারে। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের মূলখোরদের জ্বালায় অতিষ্ঠ বা বিরক্ত। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসায় অনেকটাই সন্তুষ্ট।

গত ২ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সারাবিশ্বে এখন করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা চলছে। আমাদের দেশেও এই সংক্রমণ এখনো নিরাপদ স্থানে আসেনি। এর ওপর দেশের বেশকিছু অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙন ঘটে গেছে। বলা চলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। একটি দুঃসময়ে এখন আমরা বসবাস করছি। প্রায় ৬ মাস ধরে অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক বলতে গেলে স্থবির অবস্থানে রয়েছে। দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হওয়ার যথেষ্ট বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে স্বাভাবিক হবে তা বলা মুশকিল। সে কারণেই সময়টি বড়ই কঠিন এবং জাতির জন্য দুঃসময়। এমন একটি সময়ে মানুষের আত্মরক্ষার চ্যালেঞ্জ খুবই বেদনাদায়ক। ফলে বেশিরভাগ মানুষই নিজেকে এবং পরিবারকে সংকট থেকে টিকিয়ে রাখার নিরন্তর লড়াই করে চলছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই অবস্থা প্রায় একই রকম। তেমন পরিস্থিতিতে আমরা খুব ভালো থাকার কথা নয়। তবে এখনো খাদ্য সংকট জনজীবনকে একেবারে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলে দেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্গত ও দুস্থ মানুষের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ার তেমন কোনো ঐক্যবদ্ধ মনোভাব দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারে আছে। তাই দলের নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ নানা ধরনের ত্রাণ বিতরণ, ধান কাটা ও বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কিছু অভিজ্ঞতা দেশবাসীর হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নামধারী কিছু জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় নেতাকর্মী দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশ উপেক্ষা করে অনাকাক্সিক্ষত কিছু কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে, যা গণমাধ্যমের কল্যাণে সরকার এবং জনগণের দৃষ্টিতে এসেছে। এসব ঘটনা নিয়ে সরকার বিব্রত হওয়া সত্তে¡ও দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ তা ঘটিয়েছে। এরই মধ্যে বন্যা কমে গেলেও চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এটিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করা হলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাজারকে অনেকটাই অস্থিতিশীল করে তুলছে। ফলে করোনা ও বন্যার দুঃসময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল হওয়াটি মানুষকে আরো বেশি নাজেহাল করে তুলেছে। সুতরাং এই মুহূর্তে শুধু সরকারই নয়, আওয়ামী লীগকেও সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা দেখাতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এই সভাটি রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন-যেগুলো দ্রুত কার্যকর করার মাধ্যমে এই সংকটকালে আওয়ামী লীগকে জনগণের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারে।

দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যেসব জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হয়নি সেগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ দেন। এছাড়া গত বছর দলের যেসব অঙ্গসংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দলীয় সভাপতির কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে অঙ্গসংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সুসংগঠিত করারও নির্দেশ দেন। তার এসব নির্দেশ জেলা কমিটিগুলো এবং অঙ্গসংগঠনগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করলে এই মুহূর্তের জাতীয় প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পক্ষে পূরণ করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে যেটি বাস্তব সত্য তা হচ্ছে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবস্থা অনেক জায়গাতেই খুব একটা ভালো নেই। প্রতিটি অঙ্গসংগঠনেই নানা ধরনের গ্রুপিং, পারস্পরিক দূরত্ব এতটাই জটিল হয়ে আছে যে, অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম বলতে গেলে স্থবির হয়ে আছে, একপক্ষ অন্যপক্ষকে কাজ করতে দিচ্ছে না। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেকের মধ্যেই দলীয় আদর্শ বাস্তবায়নের চেয়ে দলের পদ-পদবি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নানা রকম অভ্যন্তরীণ দন্দ্ব চলছে। অনেক জায়গাতেই বলা হচ্ছে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীরা দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। এই হাইব্রিড এবং অনুপ্রবেশকারীরা দলের কারো না কারো আশীর্বাদে দলে স্থান করে নিয়েছে, এমনকি দলীয় পদ-পদবিও বাগিয়ে নিতে পেরেছে। আবার দলের পরীক্ষিত অনেকেই এসব উক্তি নব্য ধনী নেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠতে পারছেন না। তাদের অনেকেই এখন নিষ্ক্রিয় কিংবা পদহীন অবস্থায় রয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ে দলে অনেকেই রয়েছেন এমপি, মন্ত্রী বা ক্ষমতাবান কারো না কারো গ্রুপ পরিচয়ে তারাও দলের জন্য তেমন কোনো কাজ করছেন না। বস্তুত বেশিরভাগ ইউনিয়ন ও উপজেলায় দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কোনো পক্ষই কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতীয় দিবসের কর্মসূচিও পালন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ফলে দলের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক নিবিড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পদ-পদবি ব্যবহার করে কেউ কেউ এলাকায় প্রভাব বিস্তারের বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মোটেও আগ্রহী নয়। কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত নন- এটি মোটেও বলা যাবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা কেন এসব গ্রুপিং নিরসন করে উপজেলাগুলোতে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনসহ মূল সংগঠনকে সক্রিয় করতে পারছেন না, সেটি রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে বড় জিজ্ঞাসা। সবকিছু অনুপ্রবেশকারী আর হাইব্রিডদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অন্যদের আড়াল করার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় কিনা সেটি ভেবে দেখার বিষয়। এই করোনাকালে কিংবা বন্যা ও নদীভাঙনকালে সম্মিলিতভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সরকারের দেয়া ত্রাণ ও আর্থিক সহযোগিতা সুষ্ঠুভাবে দুস্থদের হাতে পৌঁছানো, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যত্যয় ঘটেছে। যারা এই সময়ে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনি, দলীয় সভাপতির নির্দেশ উপেক্ষা করে হয় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চেষ্টা করেছে কিংবা দলের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে তারা হাইব্রিড বা অনুপ্রবেশকারী বা দলীয় সিড (বীজ) হলেও দলের পদ-পদবি পাওয়ার আশা করতে পারেন না- এটি সাধারণ মানুষের ধারণা। এখন যেসব উপজেলা জেলা কিংবা অঙ্গসংগঠন পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনি সেগুলোতে দলের প্রতি আস্থাশীল এবং এই সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে দাঁড়ানো কর্মীদেরই মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।

আওয়ামী লীগের জন্য সময়টি দলীয় বিকাশের অনুকূলে- দল সর্বত্র যোগ্য, মেধাবী, সৎ, ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান নেতাকর্মীদের দিয়ে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত এক সুতায় বেঁধে পরিচালিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এক কথায় দলের চেইন অব কমান্ড যেখানে যেখানে নষ্ট কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে সেখানে দ্রুতই রাজনীতির এই প্রথাসিদ্ধ কাজটি সম্পন্ন করতেই হবে। দলে অনেকেই আছেন নিবেদিত। আবার দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মতো পরিচয়দানকারীর সংখ্যাও কম নয়। যারা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে তাদের আওয়ামী লীগে থাকার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগে নতুন প্রজন্মের তরুণদের অনেকেই স্থান পেলে দলের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে। আবার অনেক জায়গাতেই এমন সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দল এবং অঙ্গসংগঠনকে কুক্ষিগত করে রেখেছে যাদের ভাবমূর্তির সংকট দলকেও সাধারণ মানুষের কাছে অনাগ্রহী করে তুলেছে। এই বাস্তবতাগুলো দলের যারা দায়িত্বে আছেন তাদেরই অনুভব এবং বাস্তবায়ন করা দরকার। অনেক সময় কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকেও নানা হতাশার কথা গণমাধ্যমের সম্মুখে বলতে শোনা যায়। এটি কেন হবে? আওয়ামী লীগের তো এখন দুর্দিন যাচ্ছে না। বরং আওয়ামী লীগ সময়ের এই চ্যালেঞ্জকে যেভাবে মোকাবিলা করে চলছে সেটিকে আরো বেগবান করা গেলে দুর্নীতিবাজ, তদবিরবাজ, সন্ত্রাসী, ভ‚মিদস্যু, প্রশাসনের ওপর চড়াও হওয়ার নজির যারা স্থাপন করে তাদের দল থেকে বহিষ্কার এবং বিচারের সম্মুখীন করা গেলে আওয়ামী লীগের সামনের দিনগুলো আরো সুদিনের পরিণত হতে পারে। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের মূলখোরদের জ্বালায় অতিষ্ঠ বা বিরক্ত। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসায় অনেকটাই সন্তুষ্ট। এই সন্তুষ্টির পুরো ফসল স্থানীয় ইউনিটগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ঘরে তুলে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে বা বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন কেন্দ্রীয় নেতাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে তারা এই দুঃসময়ে দলকে জনগণের আস্থায় নিতে সক্ষম হবেন।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App